আধুনিক বিশ্বে ধূমপান একটি মহামারী আকার ধারণ করেছে। অনেকে একে কেবল একটি 'খারাপ অভ্যাস' হিসেবে দেখলেও ইসলামের দৃষ্টিতে এর গুরুত্ব এবং পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। শরীর, মন এবং সম্পদ—সবকিছুর ধ্বংসকারী এই নেশা সম্পর্কে ইসলাম কী বলে? আজ আমরা আলোচনা করব ধূমপানের বিধান এবং এর ধর্মীয় ও পরকালীন পরিণতি নিয়ে।
ধূমপান কি হারাম?
প্রাচীনকালের অনেক আলেম ধূমপানকে 'মাকরুহ' (অপছন্দনীয়) বলতেন, কারণ তখন এর ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এত নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু বর্তমান সময়ের অধিকাংশ ইসলামিক স্কলার এবং বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ফতোয়া বোর্ডগুলো (যেমন- আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরবের ফতোয়া কাউন্সিল) ধূমপানকে 'হারাম' বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এর মূল কারণ হলো এটি মানুষকে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়।
পবিত্র কুরআনের আলোকে ধূমপানের নিষেধাজ্ঞা
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে মানুষের জান ও মালের ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
-
আত্মধ্বংসের পথ: আল্লাহ বলেন, "তোমরা নিজের হাতে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।" (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৯৫)। চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সারসহ হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম প্রধান কারণ।
-
অপবিত্র বস্তু বর্জন: আল্লাহ তায়ালা বলেন, "তিনি (রাসূল) তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করেন এবং অপবিত্র বস্তু তাদের ওপর হারাম করেন।" (সূরা আরাফ, আয়াত: ১৫৭)। ধূমপান একটি দুর্গন্ধযুক্ত এবং ক্ষতিকর বিষয়, যা অপবিত্র বস্তুর অন্তর্ভুক্ত।
ধূমপানের মাধ্যমে সম্পদের অপচয়
ধূমপান কেবল শরীরের ক্ষতি করে না, এটি সরাসরি অর্থের অপচয়। ইসলামে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলা হয়েছে।
-
আল্লাহ তায়ালা বলেন, "নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।" (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ২৭)। যে অর্থ দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ বা দান-সদকা করা যেত, তা পুড়িয়ে নিজের শরীরে বিষ ঢোকানো নিশ্চিতভাবেই বড় ধরনের অপচয়।
পরকালে ধূমপায়ীর জবাবদিহিতা
হাদিস শরীফে এসেছে, কিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোনো আদম সন্তান এক কদমও নড়তে পারবে না। এর মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—
সে তার সম্পদ কোন পথে ব্যয় করেছে?
সে তার শরীর বা স্বাস্থ্য কোন কাজে ব্যয় করেছে?
একজন ধূমপায়ীর জন্য এই দুটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অত্যন্ত কঠিন হবে। বিষাক্ত ধোঁয়ায় নিজের শরীর শেষ করা এবং সেই নেশায় অর্থ ব্যয় করার জন্য আল্লাহর দরবারে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
অন্যদের কষ্ট দেওয়া ও হাক্কুল ইবাদ (বান্দার হক)
ধূমপানের মাধ্যমে শুধু নিজের নয়, চারপাশের মানুষেরও ক্ষতি হয় (যাকে সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং বলা হয়)।
-
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।" (সহিহ বুখারি)।
-
এছাড়া ধূমপানের দুর্গন্ধ নিয়ে মসজিদে যাওয়া ফেরেশতা ও অন্য মুসল্লিদের জন্য কষ্টের কারণ। রাসূল (সা.) কাঁচা রসুন বা পেঁয়াজ খেয়ে মসজিদে যেতে নিষেধ করেছেন দুর্গন্ধের কারণে, আর ধূমপানের দুর্গন্ধ তার চেয়েও অনেক বেশি উগ্র ও ক্ষতিকর।
ধূমপান ছাড়ার উপায় ও আল্লাহর সাহায্য
ইসলাম আমাদের শেখায়—খারাপ কাজ ছাড়ার জন্য প্রয়োজন দৃঢ় সংকল্প (নিয়ত) এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা।
-
নিয়ত করুন: আজই তওবা করুন যে, আল্লাহর দেওয়া আমানত এই শরীরকে আপনি আর বিষ দিয়ে নষ্ট করবেন না।
-
নামাজে মনোযোগ: নিয়মিত নামাজ ধূমপানের আসক্তি কমাতে সাহায্য করে।
-
উত্তম সঙ্গ: যারা ধূমপান করে না তাদের সাথে বন্ধুত্ব করুন।
ধূমপান কেবল একটি ধোঁয়াই নয়, এটি তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া। ইসলাম আমাদের সুস্থ ও পবিত্র জীবনের শিক্ষা দেয়। তাই পরকালের কঠিন আজাব থেকে বাঁচতে এবং সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় আজই এই মরণনেশাকে 'না' বলুন।
Comments