Image description

এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে হংকংয়ের বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তের এক ভুলের মাশুল গুনেছে বাংলাদেশ। লেস্টার সিটির তারকা হামজা চৌধুরীর চোখ ধাঁধানো গোলে এগিয়ে গিয়েও প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে নিজেদের ভুলে গোল হজম করে ১-১ সমতায় বিরতিতে যেতে বাধ্য হয় হাভিয়ের কাবরেরার শিষ্যরা।

ম্যাচের শুরুটা অবশ্য হংকংয়ের আক্রমণাত্মক ফুটবলের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। ৯ মিনিটের আগে বাংলাদেশ প্রতিপক্ষের বক্সে তেমন প্রবেশ করতে পারেনি, অন্যদিকে হংকং একবার শটও নিয়েছে। মাঠে বেশ কয়েকজন 'ন্যাচারাইলজড' খেলোয়াড় থাকায় ধারণা করা হয়েছিল, হংকংই আক্রমণ বেশি করবে এবং বাংলাদেশকে রক্ষণে বেশি সময় ব্যয় করতে হবে।

তবে ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে চিত্রটা দ্রুতই পাল্টে যায়। ম্যাচের ১৩ মিনিটে ফ্রি-কিক থেকে হামজা চৌধুরীর এক অসাধারণ গোলে বাংলাদেশ লিড নেয় এবং এর পর থেকেই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি বাংলাদেশের হাতে চলে আসে। দলটি পরিকল্পিত ফুটবল খেলে হংকংকে সুযোগ দিতে অস্বীকার করে।

কিন্তু প্রথমার্ধের শেষ মুহূর্তে, বিরতির ঠিক আগে, সেই চিরাচরিত ভুল আবারও ভোগালো বাংলাদেশকে। হংকংয়ের একটি কর্নার ক্লিয়ার করতে গিয়ে ডিফেন্ডার ফয়সাল আহমেদ ফাহিম হেডে বল উল্টো নিজেদের পোস্টের দিকে ঠেলে দেন। সেখানে অফসাইডে থাকা সত্ত্বেও, বল যেহেতু বাংলাদেশের খেলোয়াড়ের হেড থেকে এসেছে, অফসাইডের নিয়ম কার্যকর হয়নি। ফাহিমের হেড থেকে আসা বল এভারটনের পায়ে পড়লে তিনি আলতো স্পর্শে জালে জড়িয়ে দেন। এক মুহূর্তের এই ভুলেই পুরো অর্ধে দারুণ খেলা বাংলাদেশের মুখ তেতো হয়ে যায়।

অথচ এর আগের পুরোটা সময় কী দারুণ খেলছিল বাংলাদেশ! কোচ হাভিয়ের কাবরেরা অসাধারণ কৌশল অবলম্বন করে দল সাজিয়েছিলেন। হামজা চৌধুরী যেন পুরো অর্কেস্ট্রার কন্ডাক্টরের ভূমিকা পালন করেন। মাঝমাঠে দুই সোহেল এবং উইথড্রন ফরোয়ার্ডের ভূমিকায় মোরসালিনের দ্রুত পাসিংয়ে বাংলাদেশের আক্রমণগুলো ছিল প্রাণবন্ত। গোল করার পর রক্ষণের সময়ে ডিফেন্স ও মিডফিল্ডের দুটি রেখাকে অল্প দূরত্বে সমান্তরালে রেখে এবং অফসাইড ট্র্যাপ তৈরি করে হংকংকে কোনো সুযোগই দিচ্ছিল না বাংলাদেশ।

এই কৃতিত্বের অনেকটাই কোচ কাবরেরাকে দিতে হবে, যিনি বেশ চাপের মুখে ছিলেন। নতুন প্রবাসী খেলোয়াড়দের আগমন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সব প্রবাসীকে দলে নেওয়ার অসহনীয় চাপ এবং ২০২৪ সালের পর দলের পারফরম্যান্সে ভাটার কারণে তার ওপর চাপ ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু এই চাপের মুখেই কাবরেরা ২০২৩ সালের সফল ছক ও কৌশলে দলকে এগিয়ে নিয়ে যান, যেখানে বাংলাদেশকে নিয়ে তিনি মন জুড়ানো পাসিং ফুটবল খেলিয়েছিলেন।

৪-১-২-১-২ ছকে, দুইজন ইনসাইড ফরোয়ার্ড এবং তাদের মাঝে একজন উইথড্রন ফরোয়ার্ড রেখে দল সাজানো হয়েছিল। রক্ষণে মাঝমাঠ ও ডিফেন্সের মধ্যে ১০-১৫ গজের ফাঁক রেখে মিড ব্লক তৈরি করা হয়। আক্রমণে ওঠার সময় মাঝমাঠে ওয়ান টাচ পাসিংয়ে দ্রুত বল উইংয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের কাবরেরার দারুণ সফল কৌশলে এবার বাড়তি সংযোজন ছিলেন হামজা চৌধুরী, যিনি প্রথাগত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড ভূমিকায় খেলেছেন।

হামজা সত্যিই অসাধারণ খেলেন, কি রক্ষণে কি আক্রমণে। ১৩ মিনিটে বাংলাদেশ আক্রমণে ওঠার পর ফাহিমকে ফাউল করায় ফ্রি-কিক পায়। মোরসালিনকে নির্দেশনা দিয়ে হামজাই ফ্রি-কিক নিতে যান এবং মুহূর্তের মধ্যে ঢাকা স্টেডিয়াম উল্লাসে ফেটে পড়ে – হামজার ফ্রি-কিক যে জাল কাঁপিয়ে দিয়েছে! জালে ঢোকার পথে হংকংয়ের খেলোয়াড়ের মাথায় লেগেছিল ঠিকই, তবে তা না লাগলেও হামজার ফ্রি-কিক ঠেকানো হংকং গোলকিপারের জন্য কষ্টসাধ্য হতো।

এরপর হামজা পুরোটা সময় ধরে একজন আদর্শ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে হংকংয়ের আক্রমণ রুখেছেন, বারবার তার দিকে ধেয়ে আসা দুই হংকং ফরোয়ার্ডের ফাঁদ এড়িয়ে পাস বের করে দিয়েছেন এবং রক্ষণকে গুছিয়ে রেখেছেন। মাঝমাঠে দুই সোহেল এবং উইথড্রন ফরোয়ার্ডের ভূমিকায় মোরসালিন ওয়ান টাচের দারুণ প্রদর্শনী রাখেন, যা বাংলাদেশের আক্রমণের গতি ও দিক বদলে দেয়।

এমন চোখ ধাঁধানো হামজার নেতৃত্বে মন জুড়ানো ফুটবল উপহার দেওয়া বাংলাদেশ এগিয়ে থেকেই বিরতিতে যাবে বলে মনে হচ্ছিল, কারণ হংকং সেভাবে সুযোগই তৈরি করতে পারছিল না। কিন্তু এরপর শেষ মুহূর্তে ওই একটি ভুলই মিষ্টি স্বাদ লেগে থাকা মুখটাকে তেতো করে দিল।