
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আগামী ১৬ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রচারণার সময় বাকি আর মাত্র ৬ ঘন্টা। শেষ সময়ের প্রচারণাকে ঘিরে উৎসবের আমেজে মেতে উঠেছে পুরো ক্যাম্পাস। নির্বাচন পেছানোর কারণে নতুনভাবে গত ৫ অক্টোবর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণা শুরু হয়েছিল, যার শেষ দিন আজ (মঙ্গলবার) রাত ১২টায়। এই সময়ে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা সকাল থেকেই ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্ট ও আবাসিক হলগুলোতে জমজমাট প্রচারণা চালাচ্ছেন।
তবে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে বিভিন্ন আকৃতি-প্রজাতির লিফলেট ও হ্যান্ডবিলের ছড়াছড়ি। প্রচারের জন্য হাতে হাতে বিলি করা এসব কাগজ মুহূর্তেই রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে। ফলে টুকিটাকি চত্বর, পরিবহন চত্বর, প্যারিস রোড, আমতলাসহ বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক ভবনের রাস্তায় কাগজের স্তূপ তৈরি হয়েছে। এতে একদিকে যেমন প্রচারণার ব্যাপকতা বোঝা যাচ্ছে, তেমনি পরিবেশ দূষণ নিয়েও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
প্রচারণার অভিনব কৌশল:
এবারের নির্বাচনে প্রার্থীরা ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নিয়েছেন নানা সৃজনশীল কৌশল। কার্যনির্বাহী সদস্য পদে একজন প্রার্থী টাকার নোটের আদলে লিফলেট ছাপিয়েছেন, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ আবার কার্টুন চরিত্র, পান্ডা, প্রজাপতি, দলিল কিংবা হাতপাখার আকারে প্রচারপত্র তৈরি করে ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন। এছাড়াও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রার্থীরা বিভিন্ন চরিত্রে সেজে কিংবা গান ও কবিতার ছন্দে নিজেদের প্রচারণা চালিয়েছেন।
হলগুলোতে ভোটারদের রুমে গিয়ে চাচ্ছেন ভোট:
নির্বাচনী উত্তাপ ঘিরে পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। রাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থীরা প্রতিদিনই ছুটে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন হলে। রুমে রুমে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন, দিচ্ছেন লিফলেট, জানাচ্ছেন নিজেদের ইশতেহার ও প্রতিশ্রুতিগুলো। সুযোগ পেলে জয়ী হলে কী কী করবেন, তাও তুলে ধরছেন তারা। ভিপি-জিএস থেকে শুরু করে সম্পাদক—স্বতন্ত্র কিংবা দলীয়—সব প্রার্থীই শেষ সময় পর্যন্ত রুমে রুমে গিয়ে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
হল সংসদের প্রার্থীদের সরব প্রচারণা:
কেন্দ্রীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি হল সংসদ নির্বাচন ঘিরেও সমান তৎপর ছিলেন প্রার্থীরা। প্রত্যেকেই আবাসিক শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো সামনে এনে দিয়েছেন সমাধানের প্রতিশ্রুতি। কোথাও প্রতিশ্রুত হয় ডাইনিংয়ের মানোন্নয়ন, হলে জিমনেসিয়াম, খেলার সরঞ্জাম সরবরাহ, কোথাও আবার দাবি ওঠে লাইব্রেরির ও পাঠ কক্ষের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির। শেষ দিনে প্রতিটি হলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেই হলের প্রার্থীরা সরাসরি মতবিনিময় ও নিজের কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপনে ব্যস্ত প্রার্থীরা।
প্রচারণার শেষ দিনেও থেমে থাকেনি রুম-টু-রুম প্রচারণা। প্রার্থীরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ভোটারদের কক্ষ কক্ষ ঘুরে সরাসরি কথা বলেছেন, নিজেদের ভিশন তুলে ধরেছেন। অনেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আড্ডায় বসে খোঁজ নিয়েছেন পড়াশোনা ও আবাসিক জীবনের সমস্যা নিয়ে। বিজয়-২৪ হলে প্রচারণা করতে দেখা যায় হল সংসদের জিএস প্রার্থী জুবায়ের জিসানকে। তিনি বলেন, 'হলের প্রতিটি রুমে রুমে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। জয়ী হলে তাদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করার জন্য কর্মপরিকল্পনা শেয়ার করছি। এতে তাদের থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।'
হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পূর্বাভাস ও প্রশাসনের প্রস্তুতি:
নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবারের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাদের নিজস্ব কৌশল ব্যবহার করে দিনরাত পরিশ্রম করছেন। বিশেষ করে ভিপি, জিএস এবং এজিএস পদে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠু ও অবাধ ভোটগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বুথের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে এবং স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের ব্যবস্থাও করেছেন তারা।
রাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক সেতাউর রহমান বলেন, 'রাকসু নির্বাচনের প্রায় সকল কাজ আমরা ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছি, শুধুমাত্র ভোটকেন্দ্র স্থাপনের কাজটি চলমান কারণ আজ পর্যন্ত ভবনগুলোতে ক্লাস-পরীক্ষা ছিল। ক্যাম্পাসে বর্তমানে রাকসু নির্বাচনের জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ বিদ্যমান। শেষ দিনের মতো প্রার্থীরা তাদের ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন এবং নিজেদের জন্য ভোট চাচ্ছেন। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলার সার্বিক পরিস্থিতিও ঠিকঠাক রয়েছে। আমরা আশা করছি আগামী ১৬ তারিখ আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সুন্দর নির্বাচন দেখতে পারব।'
শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস ও প্রত্যাশা:
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কোনো নির্বাচনে প্রথমবার ভোট দিতে যাচ্ছেন এমন অনেকেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। নির্বাচন সম্পর্কে অনুভূতি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের নবীন শিক্ষার্থী নূরে তন্নি জানায়, 'সামনে রাকসু নির্বাচন উপলক্ষে ক্যাম্পাসের এই উৎসবমুখর পরিবেশ দেখে খুব ভালো লাগছে। নবীন শিক্ষার্থী হিসেবে আসার সঙ্গে সঙ্গেই এমন একটি রাকসু নির্বাচন দেখতে পাবো এটা কল্পনাতেও ভাবিনি। বহু প্রতীক্ষার পর ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রাকসু নির্বাচন।'
প্রার্থীরা যা বলছেন:
ছাত্রদল মনোনীত 'ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম' প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবীর বলেন, 'আমরা আমাদের প্রচারণায় শিক্ষার্থীদের বেশ সাড়া পেয়েছি। তারা আমাদের ও আমাদের ইশতেহার সম্পর্কে শুনছেন এবং আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছেন। আশা করছি ১৬ তারিখ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।'
ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী ফাহিম রেজা বলেন, 'আমরা শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের কাছে যাচ্ছি এবং আমাদের ইশতেহারগুলো সম্পর্কে বলছি। শিক্ষার্থীরাও আমাদেরকে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে গ্রহণ করছে। আমরা হলে যে প্রজেকশন মিটিংগুলো করেছি সেখানে শিক্ষার্থীদের উপচে পরা ভিড় আমরা লক্ষ করেছি।'
তিনি আরোও বলেন, 'আমাদের আজকের যে প্রজেকশন মিটিংগুলো ছিল, প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে সেগুলো আমরা ক্যান্সেল করে দিয়েছি। শেষ মুহুর্তে এসে প্রশাসনের এরকম আচরণে আমরা তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।'
ছাত্রদল মনোনীত এজিএস প্রার্থী জাহিন বিশ্বাস এষা বলেন, 'আজকে শেষ দিনে এসেও আমরা শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত সাড়া ও ভালোবাসা পাচ্ছি। আমরা আশাবাদী ১৬ তারিখ একটি ভালো নির্বাচন হবে এবং একটি যোগ্য ছাত্র প্রতিনিধি আসবে।'
একমাত্র নারী ভিপি পদপ্রার্থী তাসিন খান বলেন, ‘আজ যেহেতু প্রচারণার শেষ দিন, 'আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি সবার কাছে পৌঁছাতে। তবে আমাদের সীমাবদ্ধতা হলো, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এখনো সবার কাছে পুরোপুরি পৌঁছাতে পারিনি। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এক হাতে সবকিছু সামলাতে হয়—এটা বড় একটা চ্যালেঞ্জ।’
ক্যাম্পাসজুড়ে নিরাপত্তা জারি:
প্রচারণার শেষ দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসজুড়ে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এছাড়াও নির্বাচনের দিন ক্যাম্পাসে থাকবে দুই হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য, ছয় প্লাটুন বিজিবি ও ১২ প্লাটুন র্যাবের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থা, বিএনসিসি ও স্কাউট সদস্যদের বিশেষ টহল ও দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা।
প্রক্টর অফিসের নির্দেশনা অনুযায়ী, নির্বাচনের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত যানবাহন ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন প্রবেশ, চলাচল ও অবস্থান করতে পারবে না। তবে, শারীরিকভাবে বাধাগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা এ নিয়মের বাইরে থাকবেন। গণমাধ্যমকর্মীরা কমিশনের দেওয়া পাশ প্রদর্শন করে প্রবেশ করতে পারবেন। অ্যাকাডেমিক ভবনে ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা নিষিদ্ধ থাকবে, তবে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট যানবাহন অব্যাহত থাকবে। সেদিন মোটরসাইকেল চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। পশ্চিমপাড়ায় বসবাসরত শিক্ষক-কর্মকর্তারা প্রবেশে কাজলা গেট ও প্রস্থানে প্যারিস রোড হয়ে মেইন গেইট ব্যবহার করবেন।
Comments