কুমিল্লার লাকসামে মাদকের রমরমা বাণিজ্য, ফেসবুক মেসেঞ্জারে মাদক বেচাকেনা

কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা ও পৌর শহরজুড়ে ভারত সীমান্ত থেকে আসা নিষিদ্ধ মাদকের সয়লাব দেখা দিয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে, বিশেষত ফেসবুক মেসেঞ্জারে অর্ডার দিয়ে এবং বিকাশে টাকা পরিশোধ করে এ অঞ্চলে মাদক বেচাকেনা এখন অত্যন্ত সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। পৌর শহরসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডগুলোতে মাদকের বিস্তার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এখন হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা, গাঁজা, বাংলামদসহ বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্য। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও মাদক ব্যবসা ও সেবনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। মরণনেশা ইয়াবায় ডুবে থাকছে উপজেলার উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত শ্রেণির হাজারো শিশু, কিশোর, তরুণ ও যুবক।
মাদকাসক্তির কারণে এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, পারিবারিক কলহ, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই ও খুনের মতো ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত তিন মাসে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য চুরি ও ডাকাতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির মাধ্যমে সামাজিকভাবে মাদক বয়কটের নির্দেশ দেওয়া হলেও কেউ তাতে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
যখন মাদক সেবন একটি রুটিন নেশায় পরিণত হয়, তখন নেশা ছাড়া তাদের আর কিছুই ভালো লাগে না। নেশার টাকা না পেলে তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে অভিভাবকরাও চরম উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন।
জানা গেছে, কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রেলপথ মাদক পাচারের অন্যতম নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কুমিল্লা থেকে সহজেই ট্রেনে করে মাদক লাকসাম জংশনে চলে আসে। এরপর এখান থেকে কারবারিরা এসব মাদক এক স্পট থেকে অন্য স্পটে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এক কথায়, মাদক ব্যবসায়ীরা এখন লাকসামকে মাদকের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে।
লাকসাম উপজেলায় ১টি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়ন রয়েছে। এছাড়া রয়েছে লাকসাম থানা ও জিআরপি থানা। এই দুটি থানার অধীনস্থ বিভিন্ন স্থানে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে নিষিদ্ধ মাদক হেরোইন, চোলাই মদ, ইয়াবা ও গাঁজা। এক টোপলা গাঁজা আনুমানিক ১০০-২০০ টাকা এবং প্রকারভেদে প্রতি পিস ইয়াবা প্রায় ২০০-২৫০ টাকা ও খুচরা ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অনেকে ইয়াবা বহনের কাজে কোমলমতি ছাত্র ও নারীদেরও ব্যবহার করে এই রমরমা অবৈধ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।
ইয়াবা ও গাঁজার দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় এই দুটি মাদকের দিকে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। নীরব ও সহজে বহনযোগ্য এলাকাগুলোতে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ মাদক বিক্রেতাদের দেখা যায়। উপজেলার রেল চিতোষী, পরানপুর বাজার, কৈতরা, বিজরা পূর্ব বাজার, মুদাফরগঞ্জ নগরীপাড়া, ধানকুইয়া, নাগঝাটিয়া, নোয়াপাড়া, শ্রীয়াংবাজার, সাদঘর, ইছাপুরা, মোহাম্মদপুর, কৃষনপুর আশ্রয় প্রকল্প, চরবাড়ীয়া, ইরুয়াইন দক্ষিণ, কামড্যা, জংশন রেল কলোনী, দূপচর বাজার, খুন্তা, বরইগাঁও, গ্রাম ও পৌর গাজিরমুড়া, পেয়ারাপুর নদীর পাড়, বৌ বাজার এলাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্পটে প্রকাশ্যেই মাদকের কারবার চলছে।
লাকসাম থানা সূত্রে জানা যায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযানে মাদক ব্যবসায় ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত গত ১ বছরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২৭টি ইয়াবা, ৫টি গাঁজা, ১টি ফেনসিডিল ও ১টি মদ উদ্ধার করা হয়েছে। অপরদিকে লাকসাম রেলওয়ে থানা সূত্রে জানা যায়, এ থানায় ২০২৪ সালে ৮টি মাদক মামলা এবং ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৭টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালে ৪৪ কেজি গাঁজা এবং ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৩ হাজার ৫৫০ পিস ইয়াবা, ৪৮ কেজি গাঁজা ও ৮ বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়েছে।
উপজেলা ও পৌর এলাকাসহ উপজেলা সীমান্তবর্তী বিভিন্ন স্থানে চিহ্নিত মাদকের স্পট রয়েছে ৩৪টি। গত দুই বছরে তা দ্বিগুণ বেড়েছে। বর্তমানে তা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে শহরের অলিগলি ও গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে।
এলাকাবাসীর সচেতন মহলের অভিযোগ, লাকসাম পৌর শহর ও উপজেলা ইউনিয়নের বিভিন্ন স্পটে হাত বাড়ালেই নিষিদ্ধ মাদক চোলাই মদ, ইয়াবা ও গাঁজা পাওয়া যাচ্ছে। প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, 'সোর্স পরিচয়ে উপজেলার বিভিন্ন মাদক স্পট থেকে নিয়মিত মাসোহারাও তোলা হচ্ছে।' উপজেলায় নিষিদ্ধ মাদকের ভয়াবহ বিস্তারে এলাকার অভিভাবক মহল চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় রয়েছেন বলে তারা জানিয়েছেন।
পিস ফ্যাসিলিটেটর গ্রুপ (পিএফজি) লাকসাম শাখার অ্যাম্বাসেডর আলহাজ্ব মীর মোঃ আবু বাকার সিদ্দিক বলেন, "মাদকের ভয়াল নেশার ছোবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের অল্পবয়সী যুবক ছেলেরা। ধ্বংস হচ্ছে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরাও। মাদকাসক্ত সন্তানদের নিয়ে চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়তে হচ্ছে অভিভাবকদের।"
লাকসাম রেলওয়ে থানার (ওসি) জসিমউদদীন বলেন, "লাকসাম রেললাইনকেন্দ্রিক মাদকের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে নজরদারি রাখা হচ্ছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশের প্ল্যাটফর্ম তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করছে।"
এ বিষয়ে লাকসাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাজনীন সুলতানা বলেন, "আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা যেখানেই মাদকের সন্ধান পাই আমাদের টিম সেখানেই ছুটে যায়। এছাড়া নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযানও পরিচালনা করছি। আমরা মাদক ব্যবসায়ী ও ছিঁচকে চোরদের গ্রেপ্তার করছি। আমরা আরও সতর্কাবস্থা অবলম্বন করছি।"
Comments