Image description

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ড্রাগ মাফিয়া মেহেদী হাসান রায়হানের অবৈধ মাদক ব্যবসা হতে অর্জিত অর্থ মানি লন্ডারিং এর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে উক্ত ব্যক্তি ও তার সঙ্গে সম্পর্কিতদের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের খোঁজে তদন্ত শুরু করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর, প্রধান কার্যালয়ের অপারেশনস্ ও গোয়েন্দা শাখা। 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সোমেন মন্ডল স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, ড্রাগ মাফিয়া রায়হানের গোপন সখ্যতায় সংঘবদ্ধ এ চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে সুতা, টিভি, গাড়ীর পার্টস, গার্মেন্টস পণ্যের আড়ালে অভিনব কায়দায় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে অবৈধ মাদকদ্রব্য বিপণন নেটওয়ার্ক তৈরি করে। অবৈধ মাদক বিদেশ থেকে আনার পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে মজুদ রাখার পর সুবিধাজনক সময়ে এসব অবৈধ মাদক হাত বদল হতো। ক্ষেত্রবিশেষে ট্রাক ও কনটেইনার থেকে সরাসরি ক্রেতাদের কাছেও সরবরাহ করা হতো। ২২ জুলাই ২০২২ শুক্রবার ভোরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে পাচারের সময় র‌্যাব-১১ এর নারায়ণগঞ্জের একটি আভিযানিক দল সোনারগাঁয়ের টিপুরদী এলাকার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী মহাসড়কের ওপর চেকপোস্ট বসিয়ে দুই কনটেইনার অবৈধ বিদেশী মদ জব্দ করে। এ কনটেইনার দু'টি থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৩৬ হাজার ৮১৬ বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়। এসময় রায়হানের সহযোগী মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর ইউপি চেয়ারম্যান মো. আজিজুল ইসলামের ছেলে আবদুল আহাদ সহ ৩ জনকে হাতে নাতে আটক করা হয়। উদ্ধার করা মাদকের আনুমানিক মূল্য ৪৬ কোটি ৮৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। পরে গ্রেফতারকৃতদের স্বীকারোক্তিতে ঢাকার ওয়ারীতে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন দেশের মুদ্রা জব্দ করা হয়। 

পরে সংবাদ সম্মেলন করে র‌্যাব জানায়, আইপি জালিয়াতি করে কুমিল্লা ও ঈশ্বরদী ইপিজেডের দু'টি প্রতিষ্ঠানের নাম অপব্যবহার করে মেশিনারি ও ববিন ঘোষণায় মাদকের এ চালান দু'টি খালাস করে চক্রটি। এ ঘটনায় ২৪ জুলাই ২০২২ র‌্যাব-১১ এর উপ- পরিচালক মো. শাহাদাত হোসেন বাদী হয়ে সোনারগাঁও থানায় মেহেদী হাসান রায়হান সহ ১১ জনের বিরুদ্ধে  মামলা দায়ের করে।  

সূত্রটি আরও জানায়, ড্রাগ মাফিয়া মেহেদী হাসান রায়হান, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫(৩) ধারা, চট্রগ্রামের সিএমপি থানার ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ তারিখের ১ নম্বর মামলার এজাহার ও চার্জশীট ভুক্ত আসামী। 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইন, ২০১৮ এর ৩৬ (১) সারনীর ১০ (ক),  সিএমপি এর হালিশহর থানার ২১ আগষ্ট ২০২২ তারিখের ২৮ নম্বর মামলার এজাহার ও চার্জশীট ভুক্ত আসামী। পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৪১৩ ধারার সিএমপি এর খুলশী থানার ২৮ নভেম্বর ২০২১ সালের ৪০ নম্বর মামলার এজাহার ও চার্জশীট ভুক্ত আসামী। পেনাল কোডে ১৮৬০ এর ১০৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/ ৪৭২ ধারা তৎসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর সিএমপি বন্দর থানার ৩০ জুলাই ২০২২ তারিখের ২৩ নম্বর মামলার চার্জশীট ভুক্ত আসামী। 

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪(২) (৪) ধারার নারায়নগঞ্জ সোনারগাঁও থানার ২৫ জুন ২০২৩ তারিখের ৪৬ নম্বর মামলার এজাহারভুক্ত আসামী। এছাড়াও তার বিরেুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় আরও একাধিক মামলা ও জিডি রয়েছে বলে জানায় সূত্রটি। এতোসব মামলায় অভিযুক্ত থাকার পরও পতিত আওয়ামী লীগের দাপটেই সে আশ্চর্যজনক ভাবে স্বল্প হাজত বাসে সব মামলায় জামিন পেয়ে যান।          

অনুসন্ধানে জানা যায়, ড্রাগ মাফিয়া মেহেদী হাসান রায়হান পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌরশহরের ১৩৭, রহমতপুর এলাকার মো. আলী আহমেদ ও মোসা. রেখা বেগম এর বড় ছেলে। অষ্টম শ্রেনীতে অধ্যয়নকালীন সময়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে এলাকা ছেড়ে পাড়ি জমায় চট্রগ্রাম। অসম্ভব বুদ্ধি মত্তা ও সাহস কাজে লাগিয়ে পতিত আওয়ামীলীগের হেভিওয়েট কয়েকজন নেতার ছত্র ছায়ায় চট্রগ্রাম কাষ্টমস ওয়ার হাউজ এলাকায় রায়হান গড়ে তোলে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। আইপি জালিয়াতি করে চক্রটি হাজার হাজার কোটি টাকার মাদক খালাস করে বন্দর থেকে। এবং নিরাপদে বিপনন করে নির্দিষ্ট ক্রেতাদের কাছে। মাঝে মাঝে দু'চারটি চালান আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে জব্দ হলেও বেশীর ভাগই নিরাপদে পৌঁছে যায় গন্তব্যে। আ'লীগ সরকার পতনের পর এবার ছাত্রদলের সাবেক নেতার তকমা নিয়ে এখন যুবদলের কলাপাড়া উপজেলা কমিটির পদ পেতে তদ্বির শুরু করেছে রায়হান, এমনই মন্তব্য তার রাজনীতি ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর।                        
     
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, রায়হানের বাবা আলী আহমেদ একসময় শহরের নতুন বাজার এলাকায় কাটা কাপড়ের ছোট দোকান করতো। অত:পর ব্যবসা মন্দায় শ্রমিক ভিসায় পাড়ি জমান মালয়েশিয়া। প্রবাসেও তেমন সুবিধা করতে না পেরে ফের দেশে ফিরে ব্যবসার ধরন পাল্টে ছোট ইলেকট্রনিক্সের একটি দোকান দিয়ে বসেন মহিলা কলেজ রোড এলাকায়। এরপর কিছু দিনের মধ্যেই হঠাৎ করে আলাদীনের চেরাগ পেয়ে যান তিনি। মহিলা কলেজ রোড এলাকায় ২০ লাখ টাকায় একটি দোকান ক্রয় করে ভাড়া দেন। নিজে ওয়াপদা সড়কে কয়েক কোটি টাকার মামলামাল নিয়ে শুরু করেন পায়রা ইলেকট্রনিক্স শপ। এছাড়া শহরের ১৩৭ রহমতপুর এলাকায় ৮তলা ভিত গড়ে ৫ হাজার স্কয়ার ফিটের ৪ তলা বাড়ী সম্পন্ন করেন অনুমান ৫ কোটি টাকায়। নীলগঞ্জ ইউনিয়নে নিজের নামে বেশ কিছু জমি ক্রয় করেন বলে শোনা যায়। পুবালী ব্যাংক, কলাপাড়া শাখা থেকে লোন নিয়ে ইনকাম ট্যাক্স ফাইলে জমি ক্রয়, বাড়ী তৈরীতে ব্যয় দেখান আলী আহমেদ। ড্রাগ মাফিয়া ছেলের টাকায় রাতারাতি পরিবারের ভাগ্য আকাশচুম্বী বদলে গেলেও বুদ্ধি করে ছেলের নামে কোন সম্পদ করেননি আলী আহমেদ।

এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের অপারেশনস্ ও গোয়েন্দা শাখা থেকে রায়হান ও তার সঙ্গে সম্পর্কিতদের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধানে জেলা রেজিষ্ট্রারের কার্যালয়ে চিঠি এলে তদ্বির শুরু করেন আলী আহমেদ। যাতে ছেলের নামে কোন সম্পদ পাওয়া যায়নি বলে চিঠি পাঠানো হয়। আলী আহমেদের নিজের নামের অর্থ সম্পদের কোন তথ্য প্রেরন করা না হয়।        

সম্মিলিত লাগরিক অধিকার জোট'র কলাপাড়া শাখার প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি সৈয়দ রেজাউল করিম রেজা বলেন, 'আলী আহমেদ আমার সহপাঠী ছিল। একসময় সরকারী টলে দর্জির কাজ করতো। এরপর মালয়েশিয়া থেকে ফিরে কিছুদিন দেখেছি ছোট একটি দোকান নিয়ে ইলেকট্রনিক্স মালামাল বিক্রী করতে। এতো অল্প সময়ের মধ্যে তার এতো অর্থ সম্পদ অর্জন, বহুতল বাড়ী নির্মান দেখে অবাক হয়েছি।'

কলাপাড়া বন্দর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. নাজমুল আহসান বলেন, 'একসময় তার কিছুই ছিলনা। ছেলের পাওয়া আলাদীনের চেরাগ দিয়ে এখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। তার বড় ছেলে একজন বড় মাপের ড্রাগ স্মাগলার। করোনার সময় চট্রগ্রাম কাষ্টমস থেকে ব্লাকমেইলিং করে বিদেশী পন্য খালাস করে তা পাচার করে রাতারাতি অনেক টাকার মালিক হয়ে গেছে। এজন্য অনেক বার এরেষ্ট হয়ে হাজত খেটেছে।'

এ বিষয়ে জানতে আলী আহমেদের সাথে কথা বললে তিনি দাবী করেন, তার অর্থ সম্পদ, বহুতল বাড়ী বৈধ উৎস্য থেকে অর্জিত। পুবালী ব্যাংক কলাপাড়া শাখায় দেড় কোটি টাকা লোন আছে বলে দাবী তার। তবে তার ছেলে মেহেদি হাসান রায়হান এসময় উত্তেজিত হয়ে এ প্রতিনিধিকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়ে বলেন, 'আমার  অর্থ সম্পদ সম্পর্কে জানার আপনি কে? আপনাকে কেন বলবো?? এসব দেখবে দুদক। থেমে যান, নতুবা শেষ করে দেবো।' এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সংবাদকর্মী তার নিরাপত্তার জন্য কলাপাড়া থানায় একটি সাধারন ডায়েরী দায়ের করেন, যার নম্বর ১১৫১, তারিখ ২৭ নভেম্বর ২০২৫।  

কলাপাড়া থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান বলেন, 'মেহেদী হাসান রায়হানের বিরুদ্ধে সাংবাদিককে জীবন নাশের হুমকী দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি তদন্ত শুরু করেছি। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য অনুমতি চেয়ে আদালতে আবেদন করেছি।'