মাধবপুরে খাল দূষণ ও দুর্গন্ধে বিপন্ন ১০ গ্রামের মানুষ, প্রশাসন নীরব
হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ছাতিয়াইন ইউনিয়নের রতনপুর–টু–ফান্দাউক সড়কের পাশে বয়ে যাওয়া বজ্র খাল এখন দূষণ ও দুর্গন্ধে মৃত্যুপথযাত্রী। স্থানীয়দের অভিযোগ, এলাকায় অবস্থিত গ্লোরি এগ্রো প্রোডাকশন ফ্যাক্টরি (Glory Agro Production Factory) থেকে সরাসরি বর্জ্য পানি খালে ফেলার কারণে খালের পানি কালো, তেলজাতীয় ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে গেছে।
দূষণে মৃতপ্রায় বজ্র খাল:
এক সময় এই ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ খালে নৌকা চলত, মাছ ধরা হতো, কৃষিজমিতে সেচ দেওয়া হতো। এখন খালটি দখল ও দূষণে প্রায় মৃতপ্রায়। পানির রঙ কালচে হয়ে গেছে, দুর্গন্ধে টিকে থাকা দায়। খালের পাশে গড়ে ওঠা ছয়টি শিল্প কারখানার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষণ ঘটাচ্ছে গ্লোরি এগ্রো প্রোডাকশন লিমিটেড—এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
দুর্গন্ধে হাঁপিয়ে উঠেছে এলাকা:
স্থানীয়দের ভাষায়—দুপুর ও সন্ধ্যার পর খালের পাশে টিকেই থাকা যায় না। দুর্গন্ধে আশপাশের বাড়ি, দোকান এমনকি সড়ক ধরে চলাচলকারীরাও নাক চেপে পার হন। এক সময় এই খালে নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এখন দেখা যায় কেবল মৃত মাছ। শিশুরা পানিতে নামলে চুলকানি ও ফুসকুড়িতে আক্রান্ত হচ্ছে বলে অভিভাবকদের অভিযোগ।
কৃষকদের ক্ষোভ ও দুর্ভোগ:
দূষিত পানিতে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে বলে অভিযোগ কৃষকদের। ধান ও সবজির গাছ হলুদ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই অনেকে সেচ বন্ধ করে দিয়েছেন। রতনপুর–ফান্দাউক সড়ক দিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষ যাতায়াত করেন। দুর্গন্ধের কারণে তাদেরও ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।
শোধনাগার থাকলেও অচল:
স্থানীয়দের দাবি, কারখানার বর্জ্য শোধনাগার (ETP) থাকলেও তা সচল রাখা হয় না। দীর্ঘদিন ধরে এটি অচল অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে বিষাক্ত তরল বর্জ্য সরাসরি খালে ফেলা হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে ব্যবস্থা নেওয়া হবে:
পরিবেশ অধিদপ্তরের হবিগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) বলেন, “আমরা অভিযোগ পেয়েছি এবং ঘটনাস্থল থেকে পানি নমুনা সংগ্রহ করেছি। পরীক্ষার ফল হাতে পেলে দূষণ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ:
স্থানীয় সমাজকর্মী আব্দুল কাইয়ূম বলেন, “গ্লোরির বর্জ্যের দুর্গন্ধে এলাকাবাসীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বহু মানুষ চর্মরোগ ও শ্বাসকষ্টে ভুগছেন।”
স্থানীয় বিএনপি নেতা এফ জামান বলেন, “আমরা শিল্পের বিরোধী নই, কিন্তু মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে কোনো শিল্প চলতে পারে না। সাত–আট বছর ধরে বিষাক্ত বর্জ্যের মধ্যে বসবাস করছি।”
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি আব্দুর রউফ বলেন, “এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি—এই বর্জ্য আমাদের গ্রাম, জমি আর নদী–খাল সব নষ্ট করে দিচ্ছে।”
স্থানীয় যুবদল নেতা বিল্লাল মিয়া অভিযোগ করেন, “বারবার অনুরোধের পরও গ্লোরি বর্জ্য ফেলা বন্ধ করেনি, উল্টো মামলা দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। প্রশাসনও নিরব ভূমিকা পালন করছে।”
পথচারী ও যানচলাচলকারীদের দুর্ভোগ:
রতনপুর–ফান্দাউক সড়ক দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াতকারী পথচারী আব্দুল আহাদ বলেন,
“দুপুরের দিকে এমন দুর্গন্ধ ওঠে যে নিঃশ্বাস নেওয়াই কষ্টকর হয়ে যায়।”
অটোচালক রহিম মিয়া জানান, “খালের পাশে দিয়ে অটো চালালে যাত্রীরা মুখে কাপড় চাপা দেয়। অনেকেই গন্ধের কারণে নামতে চায় না। দুর্গন্ধে যাত্রী কমে গেছে।”
গ্লোরির নীরবতা
গ্লোরি এগ্রো প্রোডাকশন লিমিটেডের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
তদন্তে দূষণের প্রমাণ :
পরিবেশ অধিদপ্তর হবিগঞ্জের সহকারী পরিচালক বলেন, “গ্লোরির বিরুদ্ধে তদন্তে দূষণের আলামত পাওয়া গেছে। ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রতিবেদন সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।”
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলেন, “আমরা পরিদর্শনে গিয়ে দেখেছি—শিল্পের তরল বর্জ্যে পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েক হাজার মানুষ চরম দুর্ভোগে আছেন। প্রশাসন এখনই ব্যবস্থা না নিলে বড় ধরনের জনরোষ দেখা দিতে পারে।”
প্রশাসনের বক্তব্য:
মাধবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহিদ বিন কাশেম বলেন, বিষয়টা আমি অবগত নই। যেহেতু এখন জেনেছি স্থানীয় প্রশাসনও বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।”




Comments