Image description

দেশে ভোজ্যতেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে স্থানীয় পর্যায়ে তেলবীজ উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে সিরাজগঞ্জ জেলায় এ মৌসুমে সরিষা চাষে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে কৃষকদের মধ্যে। জেলার মাঠজুড়ে এখন সরিষা চাষের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা।

চলতি মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ৭৩ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এজন্য ৭৩ হাজার কৃষককে দেওয়া হয়েছে প্রণোদনা—যার মধ্যে রয়েছে বিনামূল্যে সরিষার বীজ ও রাসায়নিক সার। একই সঙ্গে জেলার ৮৫ হাজার ৬০০ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককেও কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার চরাঞ্চল—যেখানে বন্যার পানি সরে গেলে জমি দীর্ঘদিন অনাবাদি পড়ে থাকে। সেই জমিগুলোতে এখন সরিষা চাষের সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। উপজেলার মাইজবাড়ি গ্রামের কৃষক রোকন বলেন, “প্রণোদনার সরিষা বীজ ও সার পেয়ে আমার অনেক উপকার হয়েছে। এই সহায়তা না পেলে খরচ জোগাতে কষ্ট হতো। সময়মতো সার দিতে পারলে ফলন ভালো হবে। আশা করছি এবার ভালো সরিষা হবে।”

নাটুয়ারপাড়া চরের কৃষক মো. সালামও মাঠে নামতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, “বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে জমি তৈরি করছি। কৃষি অফিস থেকে প্রণোদনা হিসেবে বীজ ও সার পেয়েছি। এই সহায়তা আমাদের কৃষকদের উৎসাহিত করছে।”

কাজিপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা জানান, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ইতিমধ্যেই সরিষা চাষের প্রস্তুতি শেষের পথে। চরাঞ্চলের উর্বর মাটি সরিষা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী হওয়ায় এবার উৎপাদন বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলাও সরিষা চাষে এগিয়ে রয়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সুবর্না ইয়াসমিন সুমি বলেন, “এবছর উল্লাপাড়ায় ২৪ হাজার ৫৭০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য ১৬ হাজার ১১০ জন কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। পানি নামার পর থেকেই কৃষকেরা বীজ বপন শুরু করেছেন।”

স্থানীয় কৃষক রবিউল ইসলাম জানান, “জমি থেকে পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরিষা বোনা শুরু করেছি। ইতিমধ্যে পাঁচ বিঘা বীজ বোনা হয়েছে, আরও কিছু জমিতে করব। কৃষি অফিস থেকে পরামর্শ পাচ্ছি। সরিষা তুলে পরে সেই জমিতে ধান লাগাবো।”

কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, আগের বছরের তুলনায় এবার সরিষা আবাদ প্রায় ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের বীজ বপন, সার প্রয়োগ ও রোগবালাই দমন বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন জানান, “এ উপজেলায় ৯ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর জন্য ৮ হাজার ৩১০ জন কৃষককে বিনামূল্যে বীজ ও সার প্রদান করা হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “দেশের ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণে সরিষা চাষ সম্প্রসারণে কাজ করছে কৃষি বিভাগ। আমরা কৃষকদের শুধু বীজ-সার দিচ্ছি না, মাঠ পর্যায়ে প্রযুক্তিগত সহায়তাও দিচ্ছি। সময়মতো পরিচর্যা করতে পারলে এবার সরিষার উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ হতে পারে।” ভোজ্যতেল আমদানিতে বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকার ব্যয়

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এ কে এম মঞ্জুরে মওলা বলেন, “বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়। এই বিশাল ব্যয় কমাতে দেশের কৃষকদের সরিষা চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ সরিষা উৎপাদনে দেশের শীর্ষস্থানে রয়েছে।”

তিনি আরও জানান, “চলতি মৌসুমে সিরাজগঞ্জে ৭৩ হাজার কৃষককে বিনামূল্যে বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি—চলতি মৌসুমে সরিষার উৎপাদন বিগত বছরের তুলনায় অনেক বেশি হবে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়লে দেশের ভোজ্যতেলের ঘাটতি অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব হবে।”

কৃষিবিদদের মতে, সরিষা একটি অল্প সময়ে উৎপাদনযোগ্য ও লাভজনক ফসল। ধান কাটার পর থেকে বোরো মৌসুমের শুরুর মধ্যবর্তী সময়টিতে জমি অনাবাদি না রেখে সরিষা চাষ করা যায়। এতে কৃষকের আয় বাড়ে, জমির উর্বরতাও বৃদ্ধি পায়।

সরিষা বীজ থেকে পাওয়া তেল শুধু খাবার নয়, পশুখাদ্য ও শিল্পকারখানাতেও ব্যবহৃত হয়। তাই স্থানীয় উৎপাদন বাড়লে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সরিষা চাষে প্রণোদনা পেয়ে কৃষকদের মুখে এখন আশার হাসি। অনেকে বলছেন, সরকারি সহায়তা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সিরাজগঞ্জ জেলায় ভোজ্যতেলের ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে।

কাজিপুরের কৃষক রোকনের ভাষায়— “আগে এ সময়টায় জমি ফাঁকা পড়ে থাকত। এখন সরিষা চাষে জমি কাজে লাগছে, উপার্জনও হচ্ছে। সরকার যদি এভাবে পাশে থাকে, আমরাও দেশের তেল উৎপাদনে অবদান রাখতে পারব।”

সিরাজগঞ্জ জেলায় এখন সরিষা চাষ কৃষি খাতে এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেছে। সরকারের প্রণোদনা, কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ ও কৃষকদের আগ্রহ—সব মিলিয়ে জেলার মাঠজুড়ে এখন সরিষার সম্ভাবনা। এই উদ্যোগ টেকসই হলে দেশের ভোজ্যতেল আমদানিনির্ভরতা কমে কৃষক ও অর্থনীতি উভয়ই লাভবান হবে।