শীতের আগমনে ব্যস্ত সময় পার করছে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার কম্বল পল্লীর হাজারো কারিগর। প্রতি বছর শীত এলেই যেন নতুন প্রাণ ফিরে পায় এই অঞ্চলের প্রায় ৩০টি গ্রাম। গার্মেন্টস থেকে আনা ঝুট ও গজ কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরি হয় বহুমূল্যের বাহারি কম্বল। মান ভালো ও দাম হাতের নাগালে হওয়ায় এসব কম্বলের কদর এখন সারাদেশে। প্রায় দুই দশকে গড়ে ওঠা এই শিল্প আজ কাজীপুরের অর্থনীতির বড় শক্তি। জীবিকার তাগিদে হাজারো নারী-পুরুষ এখন এই কম্বল শিল্পের ওপর নির্ভরশীল।
যমুনা নদীর ভাঙনে ক্ষতবিক্ষত কাজীপুর একসময় ছিল দুর্ভোগ আর দারিদ্র্যের প্রতীক। কিন্তু সেই উপজেলা এখন পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশের কম্বল শিল্পের ‘হাব’ হিসেবে। উপজেলার শিমুলদাইড়, শ্যামপুর, ছালাভরা, কুনকুনিয়া, ঢেকুরিয়া, বেলতৈলসহ প্রায় ৩০টি গ্রামে প্রতিটি ঘরেই চলছে কম্বল তৈরির ব্যস্ততা। এখানকার মানুষ ভাঙনে ঘরবাড়ি হারালেও থেমে থাকেনি। গার্মেন্টসের ফেলে দেওয়া কাপড়ই হয়ে উঠেছে তাদের জীবিকার প্রধান ভরসা।
একসময় মূল্যহীন এই কাপড় এখন বছরে ৩শ থেকে ৪শ কোটি টাকার কম্বল শিল্পে রূপ নিয়েছে। স্থানীয় বাজার ছাড়াও দেশের প্রায় সব জেলা শহরে পৌঁছে যাচ্ছে ‘কাজীপুরের কম্বল’। শিমুলদাইড় বাজার দেশের অন্যতম ঝুট কম্বল উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
জুলাই থেকে জানুয়ারি—এই সাত মাসই কাজীপুরের কম্বল মৌসুম। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সেলাই মেশিনের শব্দে মুখর গ্রামগুলো। নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, এমনকি অনেক বয়স্ক মানুষও জুট থেকে কম্বল তৈরির কাজে যুক্ত।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ থেকে মণ হিসেবে ঝুট কাপড় কিনে নিয়ে আসেন। মণপ্রতি দাম ৬০০ থেকে ২,০০০ টাকা। কাটিং–বাছাই শেষে নারী-পুরুষের সেলাই মেশিনেই তৈরি হয় কম্বল। এখানে পাওয়া যায় ১০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কম্বল—চাহিদা ও মান অনুযায়ী দাম ভিন্ন।
শিমুলদাইড় গ্রামের কম্বল কারিগর মরিয়ম বেগম বলেন, “কারখানা থেকে ঝুট কাপড় বাড়িতে পৌঁছে দেয়। আমরা সেলাই মেশিনে সেলাই করে কম্বল তৈরি করি। প্রতিটি কম্বলে মজুরি পাই ৩০–৪০ টাকা। বাড়ির কাজ করেই প্রতিদিন ৮–১০টি কম্বল তৈরি করতে পারি। এতে সংসারে ভালোভাবে সহায়তা করতে পারছি।” নারী শ্রমিকদের নিয়মিত আয় হওয়ায় এ অঞ্চলে নারীর ক্ষমতায়নও বেড়েছে। বেকার পুরুষ ও যুবকরাও এই শিল্পে যুক্ত হয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
কম্বল ব্যবসায়ী করিম বলেন, “শুরুতে শুধু ঝুট কম্বল বানাতাম। এখন ফ্রেশ কাপড় দিয়েও কম্বল তৈরি করি। ২০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকার কম্বল পাওয়া যায়। শুধু সিরাজগঞ্জ নয়, দেশের বিভিন্ন জেলাতেও আমরা কম্বল পাঠাই। উত্তরবঙ্গের চাহিদা একটু বেশি।”
ব্যবসায়ী রহিম জানান, “নদীতে বাড়িঘর হারিয়েছি। পরে টুকরা কাপড় কিনে এনে কম্বল বানানোর কাজ শুরু করি। প্রতিটি কম্বল ২৫০–৬০০ টাকায় বিক্রি হয়। কম্বলই আমাদের জীবিকার ভরসা।”
কাজীপুরের কম্বল ব্যবসা এখন প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টাকার লেনদেন হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যাংকিং সুবিধা না থাকায় তারা বড় পরিসরে ব্যবসা বাড়াতে পারছেন না।
মেসার্স রহিম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী রহমান দৈনিক মানবকণ্ঠ কে বলেন, “ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ থেকে কাচামাল এনে কম্বল তৈরি করি। দেশের ৪০টি জেলার ব্যবসায়ী এখানে আসেন। কিন্তু এখানে কোনো ব্যাংক শাখা নেই। অল্প সুদের ঋণ পেলে আরও বড় করে কাজ করা যেত।”
সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান বাচ্চু দৈনিক মানবকণ্ঠ কে বলেন, “প্রতি বছর কাজীপুরে প্রায় ৩শ কোটি টাকার কম্বল বিক্রি হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখানে নিরাপত্তা ও ব্যাংকিং সুবিধার ঘাটতি রয়েছে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে কথা বলেছি। একটি ব্যাংক স্থাপন জরুরি। স্বল্প সুদের ঋণ দেওয়া গেলে এই শিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে এবং হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে।”
কাজীপুরের কম্বল শিল্প এখন একটি পূর্ণাঙ্গ ক্ষুদ্র শিল্পে রূপ নিয়েছে। পাইকাররা ছাড়াও অনলাইন মার্কেটপ্লেসে বিক্রি হচ্ছে এসব কম্বল। ভবিষ্যতে সরকারি সহায়তা, ঋণ সুবিধা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ বাড়ানো গেলে এই শিল্প জাতীয়ভাবে আরও বড় জায়গা দখল করতে পারে।
একসময় নদীভাঙনে সর্বস্ব হারানো মানুষ এখন এই কম্বল শিল্পের ওপর দাঁড়িয়ে নতুন আশার আলো দেখছেন। শীত এলেই কাজীপুরের গ্রামগুলো হয়ে ওঠে ‘কম্বলের রাজধানী’—আর সেই কম্বল ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রতিটি প্রান্তে।




Comments