ঘন কুয়াশা ও আগাম শীতে কাঁপছে কুড়িগ্রাম, তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রির নিচে
ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় দেশের উত্তরের সীমান্তজেলা কুড়িগ্রামে বসেছে শীতের দাপট। টানা ৪দিন ধরে জেলার তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নীচে অবস্থান করছে। শীতের তিব্রতায় যানবাহনগুলো দিনের বেলাতেও অনেক সড়কে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে।
ভোর থেকে শুরু হওয়া কুয়াশা দুপুর পর্যন্ত স্থায়ী থাকায় জনজীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে বাড়ছে জ্বর, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, কৃষিতে ক্ষতির আশঙ্কা ও বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি। শীতজনিত অসুস্থতা এড়াতে গরম কাপড় ব্যবহার, গরম খাবার গ্রহণ ও অসুস্থতা দেখা দিলে দ্রুত শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ হতে হবে চিকিৎসকের।
সোমবার (১ ডিসেম্বর) কুড়িগ্রামে তাপমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, মঙ্গলবার (২ডিসেম্বর) ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বুধবার (৩ ডিসেম্বের) ছিল ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও বৃহস্পতিবার (৪ডিসেম্বর) ১২ দশমিক ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) সকাল ৬টায় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজারহাট আবহাওয়া কার্যালয়-এর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার।
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই কুয়াশার পরিমাণ বাড়ছে। আরও কয়েকদিন কুড়িগ্রামে শীত ও কুয়াশা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিদিনই কুয়াশার ঘনত্ব বাড়ছে। সামনে শীত ও কুয়াশা আরও বৃদ্ধি পাবে।’
ভোর থেকেই বইছে হিমেল হাওয়া। কুয়াশার ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন ছিন্নমূল মানুষ, দিনমজুর, রিকশাচালক ও বৃদ্ধরা। জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, ফসলি জমি ও ঘাসে ঘাসে জমেছে শিশিরবিন্দু। দিনের রোদের উষ্ণতা খুব বেশি সময় থাকছে না। সন্ধ্যা নামতেই বাড়ছে শীতের প্রকোপ। মধ্যরাতের পর হিমেল হাওয়ার দাপট আরও বেড়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
কুড়িগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কম্বল কেনার জন্য ৯ উপজেলাতে ৬ লাখ করে মোট ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
রমনা ঘাট ব্রহ্মপুত্র পাড় এলাকার রিকশাচালক আব্দুল সাত্তার বলেন, ‘সকালে রিকশা নিয়ে বের হলেই হাত-পা জমে আসে। কিন্তু রিক্সা না চালালে পেটে ভাতও জুটবেনা, সংসারো চলে না। যাত্রীও কম, সকাল সাড়ে ৬টায় বের হইছি এখন ৯টা বাজে। এখন পর্যন্ত মাত্র ৩০টাকা ছাড়া আর কোন ভাড়া পাইনি। আসলে যাত্রী বের না হলে রিক্সায় চড়বে কে।’
রমনা এলাকার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এই মাসে এত শীত পড়া আগে কখনো দেখিনি। এবার প্রথম এই মাসে এমন শীত দেখছি। সময় পরিবর্তনের কারণেই এমন হয়েছে বলে মনে করি।’
পানাতি পাড়ার বাসিন্দা দিনমজুর হায়দার আলী বলেন, ‘ভোরে কাজে বের হলে শরীর কাঁপে। কাজও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। আয় কমে গেছে, কিন্তু খরচতো আগের মতোই আছে।’
আয়েশা বেগম নামে এক শ্রমজীবী নারী জানান, ‘শীতের কারণে ছোট বাচ্চাদের বাইরে নিতে পারছি না। ঠান্ডা লাগলেই জ্বর-কাশি শুরু হয়ে যাচ্ছে।’
চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক আবু রায়হান জানান, শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বর, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা হাসপাতালে প্রতিনিয়ত চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান করছি।
তিনি আরো বলেন, হঠাৎ তাপমাত্রা কমে গেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। শিশু ও বয়স্করা সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে। উষ্ণ পোশাক না পরা, ঠান্ডা বাতাসে দীর্ঘক্ষণ কাজ করলে শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা দেখা দেয়।
তিনি শীতজনিত অসুস্থতা এড়াতে গরম কাপড় ব্যবহার, গরম খাবার গ্রহণ ও অসুস্থতা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন।
নদী, চর ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. সাদ কাশেম জানান, উত্তরাঞ্চলে আগাম শীত ও দীর্ঘস্থায়ী কুয়াশার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ভূমিকা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতুচক্রের স্বাভাবিক ধারা বদলে যাচ্ছে। কখনো আগাম শীত, কখনো দীর্ঘ শীত আবার কখনো অস্বাভাবিক গরম এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের ফল। আর বেশী শীতে রাস্তা দেখা যায়না এরফলে দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কনক চন্দ্র রায় জানান, চলমান শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে বিভিন্ন ফসলের ক্ষতির ঝুঁকি রয়েছে। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শীতকালীন শাকসবজি বিশেষ করে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, লালশাক, পালংশাক ও আলুর জমি। পাশাপাশি বোরো ধানের বীজতলা, মরিচ ও সরিষার ক্ষেতেও শিশির ও ঠান্ডার প্রভাবে ছত্রাকজনিত রোগ ও পচন ধরার আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি আরও জানান, ঘন কুয়াশা ও অতিরিক্ত শিশিরের কারণে পাতায় জমে থাকা আর্দ্রতা ফসলের জন্য ক্ষতিকর। এতে লিফ ব্লাইট, পাতা ঝলসানো ও ছত্রাকের আক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
কৃষকদের উদ্দেশ্যে এই কৃষি কর্মকর্তা জানান, ভোরে জমির উপর জমে থাকা শিশির দূর করতে হালকা সেচ ব্যবহার করতে হবে, বোরো ধানের বীজতলায় প্রয়োজন অনুযায়ী নালা করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা, শাকসবজি ক্ষেতে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ, কুয়াশা বেশি থাকলে সেক্ষেতে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা ও কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ ছাড়া অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন।




Comments