Image description

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল ও ক্লিনিকের এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকলেও আইন মানার ন্যূনতম বালাই নেই ঢাকার ধামরাইয়ে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গা ঘেঁষেই তিন ফসলি জমিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য ইটভাটা। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে এসব ভাটা পরিচালনা করছেন প্রভাবশালীরা, যার মধ্যে ছাত্র হত্যা মামলার আসামি ও স্কুল শিক্ষক নুরুজ্জামান বিপ্লবের নামও রয়েছে।

ধামরাই উপজেলায় বর্তমানে প্রায় দুই শতাধিক ইটভাটা পুরোদমে উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যার অধিকাংশই অবৈধ। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক ভাটা গড়ে উঠেছে বিদ্যালয়, মসজিদ, মাদ্রাসা ও ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকার সন্নিকটে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে ভাটা ভাঙা হলেও ‘ম্যানেজ’ প্রক্রিয়ায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেগুলো আবার সচল হয়ে উঠছে। পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে জরিমানা ও ভাঙচুর করার পরও পুনরায় কীভাবে এসব ভাটা গড়ে উঠছে, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।

সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার সানোড়া ইউনিয়নের মধুডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া চলছে ‘মক্কা মদিনা’ ও ‘মাস্টার্স ব্রিকস’সহ একাধিক ইটভাটা। স্থানীয়দের অভিযোগ, অতীতে আওয়ামী লীগের ইউপি চেয়ারম্যানদের প্রভাবে এসব ভাটা স্থাপিত হলেও বর্তমানে তা বিএনপি নেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে। ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ফসলি জমির ফসল, বিশেষ করে ধান পুড়ে নষ্ট হচ্ছে। টিনের ঘরের চালা ও গাছে ফল ধরছে না। এ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা উপজেলা পরিষদের সামনে একাধিকবার মানববন্ধন করলেও কোনো প্রতিকার মেলেনি।

কৃষক সোলাইমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমি ছোটকাল থেকেই কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। ইটভাটার ধোঁয়া ও গ্যাসে প্রতি বছরই জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। বাড়িতে টেকা দায় হয়ে পড়েছে, গাছের ফলও নষ্ট হচ্ছে। বাড়ির উঠান পর্যন্ত ইটভাটা চলে এসেছে।” আরেক কৃষক হাশেম আলী বলেন, “ইটভাটায় মাটি পোড়ানোর ফলে জমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। গাছপালার পাতা ও ফল নষ্ট হচ্ছে। এসব ভাটা বন্ধ না করলে পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।”

সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে মধুডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্কুলের গা ঘেঁষেই চলছে ইটভাটা। শিক্ষার্থীরা জানায়, ভাটার ধোঁয়া ও ধুলাবালি সবসময় ক্লাসরুমে প্রবেশ করে, এতে তাদের বই-খাতা ও জামাকাপড় নোংড়া হয় এবং শ্বাসকষ্ট হয়। পড়াশোনার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।

বিস্ময়কর বিষয় হলো, এই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম ‘মাস্টার্স ব্রিকস’-এর মালিক। পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকায় গত বছর প্রশাসন তার ভাটাটি ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে তিনি পুনরায় চুল্লি নির্মাণ করে ভাটা চালু করেছেন। একজন শিক্ষক হয়েও বিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করায় অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ বিষয়ে শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, “আমি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আনার চেষ্টা করছি।” ভাটা ভেঙে দেওয়ার পরও কেন পুনরায় চালু করেছেন এমন প্রশ্নের সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।

ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মঞ্জুর আল মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, “ইটভাটার কালো ধোঁয়া অত্যন্ত বিষাক্ত। এর প্রভাবে শিশুদের শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের দীর্ঘমেয়াদী জটিল রোগ দেখা দিচ্ছে।”

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম জানান, “ধামরাইয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইটভাটা রয়েছে। এসব ভাটার আগুনের তাপে প্রতি বছরই ধান পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। গত বছরও কৃষকের প্রায় ৫-৬ হেক্টর জমির ধান পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।”

ভাটা মালিকরা কার নির্দেশে বা ছত্রছায়ায় বারবার ভাটা চালু করছেন, সে বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। অনুমতি ছাড়া ভাটা স্থাপনের পরও কঠোর আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ায় স্থানীয়রা প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এ বিষয়ে ধামরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামনুন আহমেদ অনীক বলেন, “পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসন অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় পরিবেশ অধিদপ্তরের সহায়তায় অভিযান চালানো হবে। গত বছর ৩২টি ইটভাটায় অভিযান চালানো হয়েছিল। যেসব ভাটার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, পর্যায়ক্রমে সবগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হবে।”

পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খায়রুন নাহার বলেন, “ধামরাইতে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান ও মনিটরিং চলছে। যেসব ভাটার কাগজপত্র নেই, সেগুলোতে অভিযান চালানো হবে। অবৈধ ইটভাটা চলতে দেওয়া হবে না।”