Image description

অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে একাধিকবার সংবাদ প্রকাশ হলেও প্রশাসনের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ আজও চোখে পড়েনি। বরং প্রশ্ন আরও তীব্র হয়েছে—সংবাদ কি কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ, নাকি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো ইচ্ছাকৃতভাবেই চোখ বন্ধ করে রেখেছে? পরিবেশ অধিদপ্তর, উপজেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে বারবার তথ্য পৌঁছালেও মাঠপর্যায়ে কোনো দৃশ্যমান অভিযান না হওয়ায় প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তাই এখন সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয়।

এর আগে খুলনার পাইকগাছাজুড়ে অবৈধ ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ার ভয়াবহ চিত্র উঠে আসার পরও বাস্তবে কোনো পরিবর্তন আসেনি। উল্টো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অবৈধ ইটভাটা মালিকরা। প্রতিদিন ভোর হলেই সূর্যের আলো ঢেকে যায় ঘন কালো ধোঁয়ায়—দূর থেকে কুয়াশার মতো মনে হলেও কাছে গেলেই বোঝা যায়, এটি মানুষের জন্য নীরব মৃত্যুফাঁদ।

চিমনির নিচে দাঁড়িয়ে আজ আইন যেন অসহায়। ধোঁয়ার আড়ালে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট, যারা পরিবেশ আইন, কৃষিজমি সুরক্ষা আইন ও জনস্বাস্থ্য—সবকিছুকেই প্রকাশ্যে উপেক্ষা করে ইট উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব ভাটা প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নয়; বরং নীরব উপস্থিতিতেই বছরের পর বছর ধরে চলছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে—কার ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে উঠেছে এই ধোঁয়ার সাম্রাজ্য?

কৃষিজমি ও নদী—দুটিই লুটের শিকার:
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁদখালী, গদাইপুর, রাড়ুলী, হরিঢালী ও কপিলমুনি ইউনিয়নে বর্তমানে অন্তত ১৫টি ইটভাটা সরাসরি কৃষিজমির ওপর স্থাপিত। এর মধ্যে মাত্র একটি ভাটার বৈধ কাগজপত্র রয়েছে, বাকি ১৪টিই সম্পূর্ণ অবৈধ। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো—রাড়ুলী ইউনিয়নের দুটি ইটভাটার মালিক দাবি করছেন, তারা নাকি সাতক্ষীরা জেলার আওতাভুক্ত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অথচ বাস্তবে এসব ভাটাই নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করে পরিবেশ ধ্বংসের মহোৎসবে মেতে উঠেছে।

জনজীবন বিপর্যস্ত, সড়ক যেন মরণফাঁদ:
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শুকনো মৌসুমে ইটভাটা থেকে বের হওয়া ধুলাবালিতে সড়ক ঢেকে যায়, আর বর্ষা মৌসুমে সেই সড়ক কাদায় পরিণত হয়ে ভয়ংকর দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে ওঠে। শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন। শ্বাসকষ্ট, চোখ জ্বালা, মাথাব্যথা ও দীর্ঘমেয়াদি নানা রোগ এখন এলাকার মানুষের নিত্যসঙ্গী।

ভয়াবহ ঝুঁকি—যেকোনো সময় অগ্নিকাণ্ড:
অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, অধিকাংশ ইটভাটায় নেই ফায়ার এক্সটিংগুইশার, প্রশিক্ষিত শ্রমিক কিংবা জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নিম্নমানের কাঠ ও ঝুঁকিপূর্ণ জ্বালানি ব্যবহার করা হচ্ছে অবাধে। যে কোনো সময় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড বা প্রাণহানির আশঙ্কা থাকলেও দায় নিচ্ছে না কেউই।

নির্দেশ ছিল, বাস্তবায়ন নেই:
গত বছর সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহেরা নাজনীন এক প্রশাসনিক সভায় এক সপ্তাহের মধ্যে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ না করলে আইন অনুযায়ী ধ্বংস করার কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই সভায় প্রশাসনের কর্মকর্তা, ইটভাটা মালিক ও রাজনৈতিক নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু নির্দেশের এক বছর পার হলেও মাঠপর্যায়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

প্রশাসনের নতুন আশ্বাস:
বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াসিউজ্জামান চৌধুরী বলেন, তিনি সদ্য দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং দ্রুত অভিযান পরিচালনা করা হবে।

তিনি বলেন, “অবৈধভাবে কোনো ইটভাটা চলতে দেওয়া হবে না। বৈধতা না থাকলে তা ধ্বংস করা হবে।”

পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আসিফুর রহমান জানান, “পাইকগাছা একটি ক্রিটিক্যাল এলাকা। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অভিযান চালানো হবে। গত বছর পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়ন হয়নি। এবার অবশ্যই অভিযান হবে।”

কাগজে নয়, মাঠে ব্যবস্থা চায় মানুষ:
পাইকগাছার আকাশে প্রতিদিন ধোঁয়া উঠছে। কিন্তু এখনই যদি কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে এই ধোঁয়া শুধু ইট নয়—পুড়িয়ে দেবে মানুষের জীবন, কৃষি ও প্রকৃতিকেও। এলাকাবাসীর একটাই দাবি—এবার অভিযান যেন কাগজে সীমাবদ্ধ না থাকে, মাঠে দৃশ্যমান হোক।