Image description

ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মোহাম্মদপুর। একদিকে উচ্চবিত্তের আধুনিক ফ্ল্যাট, অপরদিকে বস্তি, কাঁচাবাজার, বিহারী কলোনি- সব মিলিয়ে বৈচিত্র্যময় এই এলাকায় গড়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর অপরাধ জগত। দিনদুপুরে ডাকাতি, প্রকাশ্যে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি যেন এখানে নিত্যদিনের ঘটনা। রাজধানীর অন্য কোনো এলাকায় এভাবে জনজীবন এতটা ভয়ে জর্জরিত নয়।

চাঁদা না দিলে বাঁচা যায় না: মোহাম্মদপুরের চাঁদাবাজরা যেন প্রতিটি ব্যবসা ও নাগরিক জীবনে অদৃশ্য কর আদায় করছে। টেম্পু স্ট্যান্ডে প্রতিদিন গাড়ীপ্রতি ২০ থেকে ৫০ টাকা, কাঁচাবাজারের প্রতিটি দোকান থেকে মাসে ৫০০-২০০০, নতুন বাড়ি নির্মাণে ইট-বালির গায়ে ‘সন্ত্রাসী ট্যাক্স’ খুবই মামুলি ঘটনা।

এক স্থানীয় ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা যদি মাসে  টাকা না দিই, দোকান ভাঙচুর হয়, মারধর হয়। মাঝে মাঝে জীবনের নিরাপত্তার জন্যও টাকা দিতে হয়। গত কয়েক মাসে মোহাম্মদপুর এলাকায় আবাসন-ব্যবসা, অফিস ও সাধারণ নাগরিকদের ওপর হামলা, গুলি এবং চাঁদাবাজির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্ছি হেলালের (ইমামুল হাসান) বিরুদ্ধে।

গত ২৪ মার্চ ২০২৫ তারিখে মোহাম্মদপুর-টাউন হল এলাকায় আবাসন ব্যবসায়ী মনির আহমেদের অফিসে গিয়ে চাঁদা দাবি ও সেখানে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে। এর পেছনে ‘পিচ্ছি হেলাল’ বাহিনীর সম্পৃক্ততার তথ্য এসেছে। গত ২৮ এপ্রিল একই বাহিনী মোটরসাইকেলে এসে ওই আবাসন ব্যবসায়ীর বাড়ির সামনে গুলি চালায়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। 

সম্প্রতি মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাই ও ডাকাতিকালে গণপিটুনিতে কয়েকজন নিহত ও গুরুতর আহত হয়েছে। কমপক্ষে চারজন প্রাণ হারিয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমগুলো রিপোর্ট করেছে। 

গত ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ চন্দ্রিমা মডেল টাউন এলাকায় ছিনতাইয়ের চেষ্টার সময় দুই যুবককে গুরুতরভাবে মারধর করা হয়। একজনের নাম ইয়ামিন (২৩), অপরজন ফাহিম (২৩)। ইয়ামিন ঘটনাস্থলে নিহত হন। ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ নবীনগর হাউজিং এলাকায় তিন ঘণ্টার ব্যবধানে আলাদা দু’টি স্থানে পৃথক গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। ছিনতাইকারী সন্দেহে কয়েক তরুণকে গণপিটুনি দেয় এলাকাবাসী। ঘটনাস্থলেই দুইজন মারা যান। কয়েকজনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়। 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নথি অনুযায়ী গত কয়েকবছরে ৭২টি খুন, ১৮০টি ডাকাতি ও ছিনতাই, এবং ৪০০’র বেশি চাঁদাবাজির লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাদক সংশ্লিষ্ট মামলা হয়েছে ২৫০’ও বেশি, অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চলানো হয়েছে অন্তত ৬০টি। গ্রেফতার করা হয় ১ হাজার ৪০০ জন (এর মধ্যে রাজনৈতিক পরিচয়ে জামিনে বের হয়ে যায় অর্ধেকের বেশি)। এতে বোঝা যায়, শুধু অভিযান চালিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়; বরং রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও বিচারহীনতা এই অপরাধ বিস্তারের মূল কারণ।

রাত নামলেই অন্ধকার সাম্রাজ্য: দিনের বেলা দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায় হয়Ñ আর রাতে চলে মাদক, নারী ব্যবসা ও ছিনতাই। বিহারী কলোনির অলি-গলিতে রয়েছে শতাধিক মাদক স্পট। স্থানীয় টঙ দোকানগুলোতে চলে ইয়াবা ও ফেনসিডিলের গোপন বেচাকেনা। নারী পাচার চক্র সন্ধ্যার পর সক্রিয় হয়ে ওঠে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া তরুণদের টার্গেট করে ছিনতাইকারীরা।

স্থানীয় কলেজছাত্রী জান্নাত আক্তার বলেন, সন্ধ্যার পর আমরা আর বাইরে বের হই না। রাস্তায় নেশাখোররা দাঁড়িয়ে থাকে, ছিনতাই করে, কখনো ইভটিজিং করে।

মোহাম্মদপুরে অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ: পিচ্ছি হেলাল ও প্রকাশ গ্রুপের ত্রাস: রাজধানীর জনবহুল এলাকা মোহাম্মদপুর। এর একদিকে যেমন আবাসিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদিকে তেমনি দীর্ঘদিন ধরে অপরাধ চক্রের জন্য কুখ্যাত। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এখানে বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী সক্রিয়ভাবে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, দখলবাণিজ্যসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আলোচিত দুটি নাম- পিচ্ছি হেলাল গ্রুপ ও প্রকাশ গ্রুপ, যা পুলিশের একাধিব সূত্র নিশ্চিত করে। স্থানীয়ভাবে পরিচিত ইমামুল হাসান ওরফে পিচ্ছি হেলাল এই গ্রুপের মূল হোতা হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।

অপরাধ ও অভিযোগ: প্রকাশ্যে গুলি চালানো, ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা দাবি, জমি দখল ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা বারবার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, তাদের দোকান ও অফিসে হামলা চালানো হয়েছে কেবল মাসোহারা না দেয়ার কারণে। একাধিক হত্যাকাণ্ড ও হত্যাচেষ্টার মামলায় হেলালের নাম এসেছে বলে থানা সূত্রে জানা গেছে। কিশোরগ্যাং ও মাদক ব্যবসার সঙ্গেও তার গ্রুপের যোগসূত্রের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্থানীয় প্রভাব: বাসিন্দাদের ভাষ্য- মোহাম্মদপুরে সবাই জানে কারা নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু মুখ খুললেই প্রাণের ঝুঁকি থাকে। পুলিশ মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও মূল হোতারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।

প্রকাশ গ্রুপ: স্থানীয়ভাবে আলোচিত আরেকটি নাম প্রকাশ গ্রুপ। যদিও গণমাধ্যমে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য কম, তবে এলাকাবাসীর অভিযোগ- এই চক্রও জমি দখল, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। রাজনৈতিক পরিচয় ও প্রভাবশালী মহলের সহায়তায় তারা আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

সালিশ বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি: প্রভাব বিস্তারে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, যুবকদের অপরাধে জড়ানো এসব চলতেই থাকে। অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, মোহাম্মদপুরে অপরাধ চক্রগুলো এত শক্তিশালী হওয়ার কারণ হলো- রাজনৈতিক আশ্রয় ও প্রশাসনিক দুর্বলতা। তারা মনে করেন, যতদিন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকবে, ততদিন এসব গোষ্ঠী ভেঙে দেয়া কঠিন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিলে মূল হোতারা অদৃশ্যই থেকে যাবে। 

মোহাম্মদপুরের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে। পিচ্ছি হেলাল গ্রুপ ও প্রকাশ গ্রুপ নামগুলো এখন স্থানীয়দের কাছে ভয়ের প্রতীক। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের আন্তরিক উদ্যোগ ছাড়া এদের ত্রাসের রাজত্ব ভাঙা সম্ভব নয়।

মোহাম্মদপুরের অপরাধ জগৎ মূলত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। চাঁদাবাজ চক্র, বাসস্ট্যান্ড, বাজার ও নির্মাণ কাজকে টার্গেট করে মাদক সিন্ডিকেট, বিহারী কলোনি ও আশপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণ। ভাড়াটে খুনি দল চুক্তিভিত্তিক খুন ও দখলদারিত্বে যুক্ত। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা সন্ত্রাসীরা নির্বাচনের সময়ে ‘কাজে লাগে’।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. হানিফ বলেন, আমি দুই বছর আগে বাড়ি করতে গিয়ে তিনবার টাকা দিয়েছি। একবার সন্ত্রাসীরা কাজ বন্ধ করে দেয়। পরে আবার টাকা দিতে হয়।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে গৃহবধূ অছিয়া বলেন, মাদকাসক্তরা ছিনতাইকারীরা আমার ছেলেকে হামলা চালিয়ে আহত করেছে। থানায় অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি।

সেনাবাহিনী ও যৌথ বাহিনীর অভিযান: গত দুই মাসে সেনাবাহিনী ও যৌথ বাহিনী মোহাম্মদপুরে বড় ধরনের অভিযান চালিয়েছে। এতে গ্রেফতার হয়েছে ৩ শতাধিক। অভিযানকালে বিপুল অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়। ভেঙে দেয়া হয়েছে কয়েকটি মাদকের আড্ডা। তবে স্থানীয়দের আশঙ্কা, অভিযান শেষ হলে আবারও আগের চিত্র ফিরে আসতে পারে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ তালিবুর রহমান মানবকণ্ঠকে বলেন, মোহাম্মদপুরের অবস্থা আগের তুলনায় অনেক উন্নত হয়েছে। আমরা প্রতিদিন টহল ও অভিযান চালাচ্ছি। অপরাধীরা রাজনৈতিক পরিচয়ে হলেও ছাড় পাবে না।

মোহাম্মদপুরের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম বলেন, আমরা পাড়া-মহল্লায় কাউন্সিল করছি। তরুণরাও এই কাজে যুক্ত হচ্ছে। প্রশাসনের পূর্ণ সহযোগিতা পেলে খুব স্বল্প সময়ে মোহাম্মদপুরকে চাঁদাবাজি ও মাদকমুক্ত করা সম্ভব।