পূর্ব পাকিস্তানে দমন-পীড়নের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অস্থিরতা কাটিয়ে চীন তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করছে। নিক্সন মরিয়া হয়ে ভিয়েতনাম থেকে এমন এক পন্থায় সরে আসতে চেয়েছিলেন যাতে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় অতটা ভয়াবহ বা বাজে না দেখায়। পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দিতে চীন-সোভিয়েত প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কাজে লাগাতে চাইছিলেন নিক্সন ও কিসিঞ্জার।
এই জটিল কূটনৈতিক খেলায় পাকিস্তান- বিশেষ করে দেশটির সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান নিক্সনের গোপন দূত হয়ে ওঠেন। ইয়াহিয়ার মাধ্যমেই কিসিঞ্জার এবং পরে নিক্সনের চীন সফরের পথ তৈরি হয়। নিক্সন ও কিসিঞ্জারের কাছে চীন সফর ছিল যুগ-পরিবর্তনকারী ঘটনা আর সেই ঘটনার নায়ক করতে তারা ইয়াহিয়াকে কার্যত অবাধ ক্ষমতা দিয়ে বসেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক গ্যারি জে ব্যাস তাঁর বই ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড’- এ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের ভয়াবহ ও বহুলাংশে অজানা ইতিহাসকে নতুন করে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে তিনি সে সময়কার হোয়াইট হাউসের নোংরা ও লজ্জাজনক কূটনীতির কথাও বর্ণনা করেছেন।
ইয়াহিয়ার জন্য চোখ বন্ধ রাখা
জটিল কূটনীতির বাস্তবতায় এক মাঝারি মানের দাম্ভিক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া হঠাৎই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা পান। মার্কিন প্রশাসন চোখ ফিরিয়ে রাখার সুযোগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বহু বাঙালিকে হত্যা করে। প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
গ্যারি ব্যাস তাঁর বইয়ে দেখিয়েছেন- নিক্সন ও কিসিঞ্জার কীভাবে নিজেদের কূটনৈতিক স্বার্থে এসব নিষ্ঠুরতা উপেক্ষা করেন। ঢাকায় অবস্থানকারী মার্কিন কূটনীতিকরা বারবার বার্তা পাঠিয়ে জানান, পশ্চিম পাকিস্তান পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড তো ক্ষুব্ধ হয়ে এক বিস্ফোরক বার্তা পাঠান। যেখানে ‘গণহত্যা’ শব্দটি পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু হোয়াইট হাউসের কর্ণধাররা ইয়াহিয়ার প্রতি কখনো গোপনে বা প্রকাশ্যে নিন্দা জানাননি। এমনকি পাকিস্তানের যুদ্ধযন্ত্র সচল রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও যন্ত্রাংশ সরবরাহও বন্ধ করেননি। নিক্সন তো ইয়াহিয়ার প্রতি আন্তরিকতাই দেখিয়েছিলেন। ইয়াহিয়াকে নিক্সন লিখেছিলেন, ‘আপনি যেসব কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন, সেটির বেদনা আমি বুঝি।’
গোপন টেপে নিক্সন-কিসিঞ্জার
‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম’ বইয়ের সবচেয়ে চমকে দেওয়ার মতো অংশ হলো নিক্সন ও কিসিঞ্জারের গোপন কথোপকথন। হোয়াইট হাউসের সিক্রেট টেপ থেকে পাওয়া রেকর্ডে দেখা যায়, তাদের ভাষা ছিল অবিশ্বাস্যভাবে অশ্লীল, বিষাক্ত ও ঘৃণায় ভরা। ভারতীয়দের তারা দেখতেন ধূর্ত, বিরক্তিকর এবং সোভিয়েতপন্থী হিসেবে। ইন্দিরা গান্ধীকে নিক্সন সরাসরি বলেছিলেন ‘ডাইনি বুড়ি’। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘দেশটিতে মানুষ যে কেন বংশবিস্তার করে, মাথায় ঢোকে না!’
এ ধরনের মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের অবাক নাও করতে পারে। কিন্তু এগুলো কৌশলগত বিচক্ষণতা সম্পর্কে কী বার্তা দিচ্ছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। পুরো সংকটজুড়ে নিক্সন ও কিসিঞ্জার যেন বিবেচনার চেয়ে ভারতের প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষে বেশি চালিত হন। পশ্চিম পাকিস্তানকে লাগাম না টেনে তারা রক্তাক্ত পরিস্থিতিকে আরো বিস্তৃত হতে দেন, যা শেষ পর্যন্ত আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নেয়। যখন উদ্বাস্তু স্রোত সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন ইন্দিরা গান্ধী বুঝলেন- রাজনৈতিক সমাধানের একমাত্র পথ সীমান্তের ওপারের হত্যাকাণ্ড থামানো। এর পরেই পশ্চিম পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে।
শেষ পর্যন্ত পরাজয়
যুদ্ধ শুরু হলে নিক্সন-কিসিঞ্জারের বেপরোয়া মনোভাব আরো তীব্র হয়। তারা সপ্তম নৌবহরের জাহাজ বঙ্গোপসাগরে পাঠান এবং চীনকে উৎসাহ দেন ভারত সীমান্তে সৈন্য পাঠাতে। যেটির সম্ভাব্য উদ্দেশ্য ছিল আক্রমণ করা। এই তৎপরতা সোভিয়েত ইউনিয়নকেও যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতে পারত।
সৌভাগ্যক্রমে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতারা হোয়াইট হাউসের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক ছিলেন। যুদ্ধ দ্রুত শেষ হয়; পরাজিত হয় পাকিস্তানিরা। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
পদত্যাগের পর কয়েক দশক ধরে নিক্সন ও কিসিঞ্জার নিজেদেরকে মহান কূটনীতিক হিসেবে প্রচার করে গেছেন। কিন্তু গ্যারি ব্যাসের বই দেখিয়ে দিয়েছে, সেই সুনাম কতটা অযৌক্তিক।
(গ্যারি জে ব্যাস এর বই ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড’ অবলম্বনে লিখেছেন ডেক্সটার ফিলকিন্স। তিনি নিউইয়র্ক টাইমসের সাবেক দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রতিবেদক। টাইমসে লেখাটি প্রকাশ হয় ২০১৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। সেখান থেকে সংক্ষেপে অনুবাদ করা হয়েছে।)




Comments