
জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে ১৪০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ সাজা (মৃত্যুদণ্ড) চেয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলে বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে তিনি এ আবেদন জানান।
প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালকে বলেন, "জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ১৪০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। একজন মানুষকে হত্যার জন্য যদি একবার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে ১৪০০ মানুষকে হত্যার দায়ে শেখ হাসিনাকে ১৪০০ বার ফাঁসি দিতে হবে। কিন্তু আইনে এটা সম্ভব নয়। এজন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আমরা তার চরম দণ্ড দেওয়ার জন্য আবেদন করছি। যদি তাকে এ দণ্ড দেওয়া হয় তাহলে ন্যায়বিচার পাবে দেশের জনগণ।"
তিনি আরও বলেন, অপরাধ সংঘটনের পর শেখ হাসিনা ভারত থেকে ক্রমাগত আন্দোলনকারীদের হত্যার হুমকি দিয়েছেন এবং যারা বিচার চেয়ে মামলা করেছেন, তাদেরও নির্মূলের কথা বলেছেন। "এতে বোঝা যাচ্ছে যে এত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের পরও তার মধ্যে ন্যূনতম অনুশোচনা নেই। তিনি একজন হার্ডনট ক্রিমিনালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সুতরাং এই ট্রাইব্যুনালের মামলায় তিনি যেহেতু সব অপরাধীদের প্রাণভোমরা ছিলেন, তাই তাকে আইনানুযায়ী চরম দণ্ড দেওয়া শ্রেয়।"
আসাদুজ্জামান খান কামালকে নিয়ে প্রসিকিউটর বলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল 'গ্যাং অব ফোর'-এর সদস্য ছিলেন এবং তার বাসায় বসেই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ড্রোন ওড়ানোসহ হেলিকপ্টার থেকে মারণাস্ত্র ছোড়ার সিদ্ধান্তও সেখানে হয়েছিল। তিনি নিজে গ্রাউন্ডে গিয়ে নিশ্চিত করেছেন যে হত্যা সঠিকভাবে হচ্ছে কি না। তিনি কমান্ড স্ট্রাকচারে দ্বিতীয় পজিশনে ছিলেন, তাই তার ব্যাপারেও চরম দণ্ড চাওয়া হয়েছে।
তবে, রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের শাস্তির বিষয়টি আদালতের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন প্রসিকিউশন। এছাড়াও, শহীদ ও আহতদের পরিবারের ক্ষতিপূরণের জন্য আসামিদের সম্পদ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ চেয়েছেন তারা।
এর আগে, চতুর্থ দিনের মতো বুধবার প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক চলে। এ সময় তারা বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন। তৃতীয় দিনে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের বিভিন্ন তথ্যচিত্র তুলে ধরা হয় এবং শেখ হাসিনার সঙ্গে হাসানুল হক ইনু, শেখ ফজলে নূর তাপসের কথোপকথনসহ কয়েকটি ফোনালাপ বাজিয়ে শোনানো হয়। ১৩ অক্টোবর দ্বিতীয় দিনের যুক্তিতর্কে বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। ১২ অক্টোবর থেকে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু হয়, যেখানে চিফ প্রসিকিউটর আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলের ইতিহাস এবং গুম-খুনসহ নারকীয় সব ঘটনার বর্ণনা দেন।
গত ৮ অক্টোবর মামলার মূল তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরকে তৃতীয় দিনের মতো জেরা সম্পন্ন করেন শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। এরপর যুক্তিতর্কের জন্য দিন নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল। এ মামলায় মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশন তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ এনেছে। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার, যার মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার। এ মামলায় ৮১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা।
Comments