Image description

সামরিক জান্তার হাত থেকে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) যখন রাখাইন রাজ্যের ‘নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ’ নিয়েছিল, তারপর কিছুদিন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত শান্ত ছিল। কিন্তু সম্প্রতি রাখাইন রাজ্যে সংঘাত আবার তীব্র হওয়ায় তা উখিয়া ও টেকনাফের সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।

নাফ নদীর ওপার থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূর থেকেও গোলাবারুদ ছিটকে এসে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বাড়িঘরে পড়েছে। গত ২৫ অক্টোবর আসা গুলিতে তেচ্ছিব্রিজ এলাকার ছেনুয়ারা বেগম আহত হন এবং ২৬ অক্টোবর আমতলী গ্রামের বাসিন্দা আইয়ুব ইসলামের ঘরের টিনের চাল ছিদ্র করে দেয় গুলি।

রাখাইনে এখন আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী এবং রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরসা ও আরএস ও উভয়েই যুদ্ধ করছে। জান্তা সরকার তাদের হারানো ঘাঁটিগুলো পুনরুদ্ধার করতে চাইছে, আর রোহিঙ্গারা তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চাইছে।

কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি মো. ছিদ্দিক স্বজনদের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, রাখাইনের শাহাববাজার ও কোয়াঞ্চিপ্রংসহ কয়েকটি এলাকায় আরাকান আর্মি ও আরসা সদস্যদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ চলছে, এতে উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। তিনি আরও জানান, প্রায় ১৭ জনের একটি গ্রুপ ছিল, যাদের কয়েকজন মারা গেছে এবং কয়েকজন এখনো নিখোঁজ।

রাখাইনের এই ক্রমাগত সংঘাতের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ২১৭ কিলোমিটার সীমান্ত এখন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত স্থলমাইন বিস্ফোরণ, গুলি ছুটে আসা, সমুদ্রগামী জেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া, যুদ্ধাহতদের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসে চিকিৎসা নেওয়া এবং আতঙ্কিত রোহিঙ্গাদের চলে আসার মতো ঘটনাগুলো ঘটছে।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, "সীমান্তের ওপারে প্রায়ই গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। আর এপারে মাত্র এক কিলোমিটার দূরেই রয়েছে বিশাল রোহিঙ্গা ক্যাম্প। মাঝখানে আমরা স্থানীয় বাসিন্দারা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। প্রায়ই সীমান্ত পেরিয়ে গোলা এসে পড়ে গ্রামাঞ্চলে।"

২০২৪ সালে আরাকান আর্মি রাখাইনের ১৭টির মধ্যে ১৪টি প্রশাসনিক এলাকা দ্রুত দখল করে ‘সফলতা’ অর্জন করলেও এক বছরের ব্যবধানে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এখন জান্তাবিরোধী অন্যান্য বিদ্রোহী জোটের মধ্যে ‘নিষ্ক্রিয়তা’ দেখা যাচ্ছে এবং আরাকান আর্মিকে আরসা ও আরএসওর যুদ্ধ-তৎপরতার কারণে নিজেদের ঘাঁটিগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হচ্ছে।

কিছুদিন আগে আরাকান আর্মির প্রধান তুন মাইয়াত নায়িং অভিযোগ করেন, আরসা ও আরএসওর হামলার পেছনে ‘বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের মদদ’ রয়েছে। যদিও এই অভিযোগকে ‘বিভ্রান্তিকর’ বলছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষা বাহিনী-বিজিবি।

বিজিবি পাল্টা অভিযোগ করে বলেছে, উত্তর মংডু এলাকায় দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে আরাকান আর্মি নিজেই গভীর সংকটে পড়েছে। "মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ততা, লুটপাটের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বিরোধ, মনোবল ভাঙন ও সেনাদের মানসিক ক্লান্তি- সব মিলিয়ে অনেক যোদ্ধা দলত্যাগ করেছে।"

এদিকে, যুদ্ধাহত আরসা বা আরএসও সদস্যরা বাংলাদেশে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলেও জানা গেছে। উখিয়ার ৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক যুদ্ধাহত কিশোর দাবি করেছে, আরও অনেকের সঙ্গে নাফ নদী পেরিয়ে গিয়ে তারা আরসার হয়ে 'মাতৃভূমি' মুক্ত করার জন্য যুদ্ধ করেছে।

সীমান্তে শান্তি ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। বিজিবি-৬৪ উখিয়া ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, "আমরা সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছি। সীমান্তে অতিরিক্ত টহল ও সরঞ্জাম মোতায়েন করা হয়েছে।"

তিনি সীমান্তবাসীকে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকার এবং গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বিজিবি আরও জানিয়েছে, মায়ানমারের অভ্যন্তরে সশস্ত্র সংগঠন বা যে কোনো গ্রুপ অথবা যে কেউ অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে তা কঠোরভাবে প্রতিরোধ করা হবে।