কপ৩০–এ তরুণ বার্তা
প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়, চাই তাত্ক্ষণিক বৈশ্বিক পদক্ষেপ
ব্রাজিলের বেলেমে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেইনফরেস্ট আমাজনের কেন্দ্রস্থলে এবারের জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ৩০ অনুষ্ঠিত হয়েছে এক অভূতপূর্ব বৈশ্বিক পরিবেশে। ১৯০টিরও বেশি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, বিজ্ঞানী, জলবায়ু গবেষক, তরুণ প্রতিনিধি এবং নাগরিক সমাজের উপস্থিতিতে আলোচনার মূল কেন্দ্রে ছিল—১.৫°C লক্ষ্য, জলবায়ু ন্যায়বিচার, ক্ষয়ক্ষতি তহবিল, অর্থায়ন এবং আমাজন রক্ষা। কপ৩০–এর পুরো সময়জুড়ে আলোচনায় ছিল ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানের জলবায়ু বাস্তবতা এবং মানবতার অস্তিত্ব রক্ষায় তাত্ক্ষণিক বৈশ্বিক পদক্ষেপের জরুরি প্রয়োজন।
এবার কনফারেন্সে বাংলাদেশি তরুণদের উপস্থিতি ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নে আয়োজিত “১.৫°C অ-আলোচনাযোগ্য: দ্রুত ও ন্যায্য রূপান্তরের জন্য বাংলাদেশি তরুণদের আহ্বান” শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের ডায়ালগে তরুণ জলবায়ু নেতারা স্পষ্ট বার্তা দেন—১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্য রক্ষা ছাড়া বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়। ব্রাইটার্স, বাংলাদেশ ইউথ ক্লাইমেট কোয়ালিশন, ক্লাইমেট সিটিজেন নেটওয়ার্ক এবং বাংলাদেশ ইয়ুথ কপ যৌথভাবে এই উদ্যোগ নেয়। ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত সেশনটিতে উপস্থিত ছিলেন তরুণ নেতা, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, একাডেমিয়া, সরকারি কর্মকর্তা এবং সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধিরা।
সেশনটি সঞ্চালনা করেন ব্রাইটার্স-এর ফারিহা ঔমি এবং মূল উপস্থাপনা দেন ব্রাইটার্স-এর প্রতিষ্ঠাতা সাইদুর রহমান সিয়াম। তিনি তার উপস্থাপনায় তুলে ধরেন সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক তথ্য, বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতির ঘাটতি এবং তরুণদের নেতৃত্বে একটি ন্যায়সঙ্গত ও দ্রুত রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা। বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনে অবদান খুবই কম হওয়া সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভাবের ভার বইছে দেশের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী। তাই ১.৫°C লক্ষ্য শুধু একটি সংখ্যাগত মূল্য নয়—এটি অস্তিত্বের সীমারেখা। বড় নির্গমনকারী দেশগুলোকে দ্রুত ডিকার্বোনাইজেশন, ক্ষয়ক্ষতির (Loss & Damage) সহায়তা, এবং সহজপ্রাপ্য জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতেই হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ইআরডি’র অতিরিক্ত সচিব এ কে এম সোহেল তার বক্তব্যে তরুণদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। তিনি জানান, ইআরডি আগামী বছর একাধিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আয়োজন করবে, যেখান থেকে সেরা দশ তরুণকে দেওয়া হবে পার্টি ব্যাজ। এই উদ্যোগ তরুণদের জলবায়ু–সংক্রান্ত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ আরও শক্তিশালী করবে।
প্যারিস চুক্তির অগ্রগতি মূল্যায়নের জন্য প্রকাশিত গ্লোবাল স্টকটেক (GST) রিপোর্টে উঠে আসে ভয়াবহ বাস্তবতা। বর্তমান বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ২.৪°C থেকে ২.৮°C পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে—যা মানবিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের ইঙ্গিত বহন করে। ১.৫°C সীমা রক্ষা করতে ২০২৫–২০২৯ সালের মধ্যেই বিশ্বের বড় অর্থনীতিগুলোকে ব্যাপক হারে নির্গমন কমানোর কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জোট জানায়, প্রতিশ্রুতি নয়—এখন বাস্তবায়নের সময়।
এই বছরের কপের কেন্দ্রবিন্দু ছিল আমাজন রেইনফরেস্ট। ব্রাজিল সরকার ঘোষণা দিয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে অবৈধ বন উজাড় শূন্যে নামানো, নতুন সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা, বন ধ্বংসকারী শিল্পের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভূমির অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিতের পরিকল্পনা। প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা বলেন, “আমাজন শুধু ব্রাজিলের নয়—এটা বিশ্বের শ্বাসকেন্দ্র। এর সুরক্ষায় বিশ্বেরও সমান দায়িত্ব রয়েছে।”
কপ৩০–এ জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর প্রধান দাবিগুলোর একটি ছিল ক্ষয়ক্ষতি তহবিল (Loss & Damage Fund) দ্রুত বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশসহ ৫০টিরও বেশি দেশ জানায়, এই তহবিল ছাড়া অভিযোজন বা পুনর্বাসন কাজ করা সম্ভব নয়। উন্নত দেশগুলো অর্থায়নে প্রস্তুতি দেখালেও তারা ব্যবস্থাপনায় আরও স্বচ্ছতার দাবি জানায়।
সম্মেলনের টেকনোলজি জোনে প্রদর্শিত হয় বিভিন্ন উদ্ভাবনী প্রযুক্তি—কার্বন ক্যাপচার টেকনোলজি, উন্নত সৌর প্যানেল, রিয়েল-টাইম বন্যা–সতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও পুনর্জাগরণযোগ্য কৃষি প্রযুক্তি। বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল জানায়, এসব প্রযুক্তি উপকূলীয় এলাকায় সুরক্ষা বৃদ্ধি এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
এবারের কপে প্রায় ১০ হাজার তরুণ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন এবং বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে স্পষ্ট বার্তা দেন—সময়মতো সিদ্ধান্ত না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে। বাংলাদেশি তরুণরাও ইভেন্টের শেষে বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে যৌথ বার্তা দেন—আগামী কপ সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তব পদক্ষেপ দেখতে চায় তরুণ প্রজন্ম। দ্রুত, ন্যায়সঙ্গত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রূপান্তর নিশ্চিত করার দায়িত্ব এখনই নিতে হবে বিশ্বনেতাদের।
কপ৩০ আমাদের আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে—জলবায়ু সংকট ভবিষ্যতের নয়; এটি বর্তমানের কঠিন বাস্তবতা। সংকট সমাধানে প্রয়োজন দ্রুত অর্থায়ন, কার্বন নির্গমন কমানো, আমাজন রক্ষায় বৈশ্বিক ঐক্য এবং জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর প্রতি ন্যায়সঙ্গত সহায়তা। বিশ্ব এখন অপেক্ষায়—এই প্রতিশ্রুতিগুলো কত দ্রুত বাস্তবে রূপ পায়।




Comments