Image description

বিনোদনের সংজ্ঞা হলো “যে কাজটি করার সময় মস্তিষ্ক পুরোপুরি সম্মতি দেয় এবং কাজটি চলার সময় stress কমিয়ে দেয় সেটিই বিনোদন। ‘রিক্রিয়েশন’ শব্দটি ইংরেজিতে প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল ১৪ শতকের শেষের দিকে, প্রথমে ‘অসুস্থ ব্যক্তির সতেজতা বা নিরাময়’ এর জন্য। রিক্রিয়েশন শব্দটি ল্যাটিন থেকে উদ্ভ‚ত এর অর্থ, re-‘আবার’, creare-‘সৃষ্টি করা, প্রসব করা, জন্ম দেয়া’।

বিনোদন হলো অবসরের একটি কার্যকলাপ, অবসর হলো বিচক্ষণ সময়। ‘বিনোদনের জন্য কিছু করার প্রয়োজন’ মানব জীববিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানের একটি অপরিহার্য উপাদান। বিনোদনমূলক কার্যকলাপ প্রায়শই উপভোগ, বিনোদন বা আনন্দের জন্য করা হয় এবং এগুলোকে ‘মজাদার’ বলে মনে করা হয়। 

বিনোদন, চিত্তবিনোদন বা মনোরঞ্জন এমন এক ধরনের কাজ যা দর্শক বা শ্রোতার আকর্ষণ বা আগ্রহের বিষয় এবং যা তাদের আনন্দ প্রদান করে। বিনোদন কোনো ধারণা বা কাজ হতে পারে কিন্তু হাজার বছর ধরে দর্শক বা শ্রোতা আগ্রহ ধরে রেখেছে এমন কাজ হতে হবে।


বিনোদনের অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে এবং সেই অনুযায়ী, এই প্রভাবের সুবিধা গ্রহণের জন্য থেরাপিউটিক রিক্রিয়েশন তৈরি করা হয়েছে। ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর থেরাপিউটিক রিক্রিয়েশন সার্টিফিকেশন (NCTRC) হলো থেরাপিউটিক রিক্রিয়েশন পেশার জন্য জাতীয়ভাবে স্বীকৃত প্রশংসাপত্র প্রদানকারী সংস্থা। NCTRC দ্বারা প্রত্যয়িত থেরাপিউটিক রিক্রিয়েশনের ক্ষেত্রে পেশাদারদের ‘সার্টিফাইড থেরাপিউটিক রিক্রিয়েশন স্পেশালিস্ট’ বলা হয়। মার্কিন শ্রম বিভাগের পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘রিক্রিয়েশন থেরাপিস্ট’ পদের নাম চিহ্নিত করা হয়েছে।

এই ধরনের থেরাপি পুনর্বাসন, যুবক এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মানসিক চিকিৎসা সুবিধা এবং বয়স্ক, প্রতিবন্ধী বা দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের যতে্ন প্রয়োগ করা হয়। স্থূলতা এবং অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কমাতে বিনোদনমূলক শারীরিক কার্যকলাপ গুরূত্বপূর্ণ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি, বিশেষ করে পুরুষদের ক্ষেত্রে কোলন এবং প্রোস্টেটের ঝুঁকি এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে স্তনের ঝুঁকি; তবে, সমস্ত ম্যালিগন্যান্সি হ্রাস পায় না কারণ বাইরের বিনোদন মেলানোমার উচ্চ ঝুঁকির সাথে যুক্ত। চরম অ্যাডভেঞ্চার রিক্রিয়েশন স্বাভাবিকভাবেই নিজস্ব ঝুঁকি বহন করে না।

অনেক বিনোদনমূলক কার্যক্রম সংগঠিত হয়, সাধারণত সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ-ওয়ার্ক এজেন্সি, সদস্যপদ ফি দ্বারা সমর্থিত ব্যক্তিগত গোষ্ঠী এবং বাণিজ্যিক উদ্যোগ দ্বারা। [এর প্রতিটির উদাহরণ হলো ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস, ওয়াইএমসিএ, কিওয়ানিস এবং ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ড। পার্ক এবং সৈকতের মতো পাবলিক স্পেস অনেক বিনোদনমূলক কার্যকলাপের জন্য অপরিহার্য স্থান এবং পর্যটন স্বীকৃতি দিয়েছে যে অনেক দর্শনার্থী বিশেষভাবে বিনোদনমূলক অফার দ্বারা আকৃষ্ট হন। বিশেষ করে, ক্যালিফোর্নিয়ার ভেনিস বিচের সমুদ্রসৈকত এলাকা, কানের প্রোমেনেড দে লা ক্রোয়েসেট, নিসের প্রোমনেড ডেস অ্যাংলাইস বা ট্রিয়েস্টে মিরামেয়ার ক্যাসেলসহ বারকোলার লুঙ্গোমারের মতো সমুদ্রসৈকত এবং জলপ্রান্তের প্রোমনেডগুলো একদিকে শহরের জনসংখ্যার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিনোদনমূলক এলাকা এবং অন্যদিকে স্থানীয়দের জন্য সমস্ত সুবিধা এবং অসুবিধাসহ গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন গন্তব্য।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিনোদনের  কার্যক্রম সময় এবং অবস্থার প্রেক্ষাপটে নানাভাবে সংগঠিত হয়েছে। প্রাচীন বাংলায় বিনোদনের জন্য গ্রামের মানুষরা নিজস্ব সংস্কৃতির অবয়বে নানা কার্যক্রম পরিচালিত করত। 

এখনও শীতের সময় সন্ধ্যা নামলেই মেলার মাঠ থেকে লাউড স্পিকারে আর ভেসে আসে না ‘হৈ হৈ কাণ্ড, রৈ রৈ ব্যাপার নাচে গানে মন মাতবে সবার অদ্য রজনির বিশেষ আকর্ষণ’। তবে এখন আর তিন দশক আগের মত যাত্রা পালার প্রচলন নেই। তাই যাত্রাপালা দেখার জন্য দর্শক সারা রাত বিনিদ্র থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আর অপেক্ষায় থাকে না। শীতে গ্রাম্য মেলা বসবে, যাত্রাপালা আসবে  সেই প্রতীক্ষায় এখন আর কেউ  থাকে না, আর গ্রাম-বাংলার মানুষও। যাত্রাশিল্পের এখন ঘোর দুর্দিন। বর্তমানে দেশে যাত্রাপালার অনুমোদন অঘোষিতভাবে বন্ধ। আর গ্রামের যুবকরা যাত্রাপালার আয়োজন করতে পারে না প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া। বাউল গান, লালনের আসর, বয়াতি গানের বির্তক এসবও প্রশাসনের এখতিয়ার বহিভর্‚তভাবে করা যায় না। সুতরাং বাংলার মূল সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষের বিনোদনের বিষয়টা ক্রমশই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। 

চৈত্র বা বৈশাখের শুকনো আবহাওয়াতে যখন সারাদিন পর একটু শান্তির আশাতে সবাই গা এলিয়েছে বা ঘুমিয়েছে হয়তো গ্রামীণ কোনো বৈশাখে আধা শুকনা নদীর তটে নৌকার উপর বসে বা মাঠের ফুরফুরে হাওয়াতে কোনো বংশীবাদক তরুণের মন পাগল করা সুরেলা বাঁশির সুর ভেসে আসতো। আবহমান গ্রাম-বাংলার এক চিরন্তন রোমান্টিক ক্লাসিকের নাম এই বাঁশির সুর। চাঁদনী রাত আর বাঁশির সুর আবহমান গ্রাম বাংলার ক্ল্যাসিক রোমান্সের এক অবিচ্ছেদ্য অনুসঙ্গ। বৈশাখী মেলাতে গ্রামে নাগরদোলায় চড়া, মাটির তৈরি খেলনা, গ্রামে তৈরি মিষ্টি ছিল বিনোদনের একটি অপরিহার্য অংশ। সারাদিনে আনন্দ যেন শেষ হতে চাইতো না। একটা সময় বা এখনো কারো কারো কাছে, পত্রিকা পড়া, লিটন ম্যাগ বা ম্যাগাজিন পড়া, গল্পের বই পড়া, গান শোনা, মাছ ধরা, বিনোদন আনন্দের একটি বড় উপাদান। তবে এই ব্যবস্থাগুলো এখন ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে। 

এখন আমাদের কাছে ইন্টারনেটের কল্যাণে ফেসবুক, ইউটিউব সব আছে। ইন্টারনেট বা ফেসবুকের আমাদের মাঝে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান নাটক, বিদ্রোহী কবি নজরুলের গান কবিতা গজলসহ নানাবিধ বিনোদনের উপকরণ পাওয়া যায়। তাছাড়া ইন্টারনেটের মাধ্যমে, পাভেল বাঝোভের রুশ ক্ল্যাসিক মালাকাইটের ঝাপি এ ধরনের বইও পাওয়া যায়। একজন উত্তম-সুচিত্রা জুটি, কবরী রাজ্জাক জুটি, সত্যজিত রায়ের বিখ্যাত ছবিগুলোও দেখা যায়। তবে পাশাপাশি ইউটিউব চ্যানেল চালু হয়েছে, চালু হয়েছে টিকটকসহ নানা ধরনের ই-নেটভিত্তিক বিনোদন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাগুলো রগরগে পর্নোগ্রাফির অবয়বে ছাঁচে গড়া।

যা রবীন্দ্র নজরুল সুকান্ত ই-নেটের গান কবিতার চেয়ে বেশি প্রচার বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে কোন ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা ভাবা দরকার। আমরা জানি যে বিনোদনের মাধমে stress কমায়। মানুষের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থের বিকাশ ঘটায়। কিন্তু বর্তমানে বিনোদন যে পদ্ধতিগুলো সমাজে ব্যবহƒত হচ্ছে তা কি আদৌ stress কমাচ্ছে? মানুষের শারীরিক, মানসিক অসুস্থতা বাড়াচ্ছে। সারা রাত জেগে মানুষ এখন যাত্রা দেখে না।  উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণী বা ২৫ থেকে ৬৫ বছর বয়স্ক মানুষ রাত জেগে ইন্টারনেটে নানা ধরনের বিনোদন উপভোগ করে। এসব দেখার পরও কি কমছে স্থ‚লতা, ব্যাক্তির মানসিক এবং পারিবারিক অশান্তি। কারণ যাত্রাপালাটা ছিল বছরের একটা নিদিষ্ট সময়ের জন্য, যা সারা বছর মানুষকে রাত জাগাতে অনুপ্রাণিত করত না, বাংলার ষড়ঋতুর সাথে সম্পর্কিত ছিল বাঙালি সংস্কৃতির বিনোদন।

এই ঋতুভিত্তিক, পালা গান, জারী গান, সারি গান, নৌকা বাইচ, গীতি যাত্রাপালাসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্কৃতি কমতে শুরু করেছে। এখন আর বিনোদনের সেই ব্যবস্থাটা নাই। ফলে ই-নেটের মাধ্যমে যে বিনোদন চালু হচ্ছে তা অনেকটা অরুচিকর। মানুষ যদি অরুচিকর খাবার গ্রহণ করে তাহলে তার শরীরে নানা ধরনের অসুখ দেখা যায়। বর্তমানে সমাজে ই-নেটের মাধ্যমে অরুচিকর সংস্কৃতির প্রচলন ঘটায় সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সমাজে জন্ম নিচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের মতো অপরাধী চক্র। ই-নেটের মাধ্যমে বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির প্রচলন ঘটাতে না পারলে মানুষ অসুস্থ, রুচিহীন সংস্কৃতির দিকে ধাবিত হবে। যা সমাজ তথা ব্যক্তির শারীরিক মানসিক বিকাশের প্রবাহমান ধারাকে বিপথে পরিচালিত করবে। 

লেখক: কলামিস্ট