
বাংলাদেশে গৃহস্থালি ব্যয়ে পরিবর্তন এসেছে। রূপান্তর ঘটেছে গৃহস্থালি কাঠামোতে। গ্রামীণ সভ্যতায় অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রতিফলন ঘটছে। প্রতিফলন ঘটছে সমাজের জীবনযাত্রা ও মানুষের মনোভাবেও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে গৃহস্থালি ব্যয়ের খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। খাদ্য ব্যয়ের হার কমেছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ব্যয় বেড়েছে। গৃহস্থালি ব্যয়ের পরিবর্তিত রূপ সমাজ, অর্থনীতি ও জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব ফেলছে। প্রথাগতভাবে বাংলাদেশের গৃহস্থালির অধিকাংশ ব্যয় খাদ্য খাতে ছিল। ২০১০ সালে একটি পরিবারের মাসিক গড় ব্যয়ের ৫৬ শতাংশ খাদ্য খাতে ব্যয় হতো।
বর্তমানে, ২০২৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী খাদ্য ব্যয়ের হার কমে ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এ পরিবর্তন জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ এর পেছনে রয়েছে আয় বৃদ্ধির প্রচেষ্টা, সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি ও ভিন্ন ভিন্ন খাতে ব্যয় করার প্রবণতা। বিশ্বব্যাংকের ২০২৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আয় বৃদ্ধির ফলে মানুষের খাদ্য ব্যয়ের তুলনায় চিকিৎসা, শিক্ষা এবং প্রযুক্তি খাতে ব্যয় বেড়েছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে খাদ্য ব্যয়ের হার গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অধিক কমেছে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং রেস্টুরেন্টে খাবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে অভিভাবকদের ব্যয় দিন দিন বেড়ে চলেছে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসন সীমিত।
আবার গ্রামাঞ্চলে মানসম্মত শিক্ষার অভাব স্পষ্টত দৃশ্যমান। এ কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক অবস্থান নিয়ে গ্রামের মানুষের শিক্ষা ব্যয় বাড়াচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চ ব্যয় সাধারণ মানুষের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিন্ম-মধ্যবিত্ত পরিবারের মাসিক শিক্ষা ব্যয় গড়ে ৬,০০০ থেকে ৮,০০০ টাকা। কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট টিউটরদের উপর নির্ভরতা বেড়েছে ৭৩ শতাংশ। শিশুদের সহশিক্ষা কার্যক্রমে ব্যয় বেড়েছে ৬০ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
তবে এই ব্যয় অনেক পরিবারকে আর্থিক চাপে ফেলছে। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং অন্যান্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার জন্য শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত খরচ বাড়ছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা সীমিত। বাধ্য হয়েই অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় মানেই অস্বাভাবিক ব্যয়। ব্যয়ের এই অসম ভারসাম্য সামলাতে হিমশিম খেতে হয় মধ্যবিত্ত ও নিন্ম-মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত ক্রমেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষ বেসরকারি হাসপাতাল সেবার দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু বেসরকারি সেবায় উচ্চ ব্যয়ের কারণে নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য স্বাস্থ্য সেবা নেয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) সা¤প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে ৪৩ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্য খরচ মেটাতে তাদের সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হচ্ছে। ১০ শতাংশ পরিবার ঋণ করে চিকিৎসা খরচ মেটাচ্ছে। বিশেষত দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগ ইত্যাদির চিকিৎসা ব্যয় আগের তুলনায় ৭৮ শতাংশ বেড়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় আরও বেড়েছে। বহু পরিবারকে তাদের আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ ব্যয় করতে হয়েছে চিকিৎসা সেবার জন্য। ফলে প্রতিনিয়ত তাদের আর্থিক সংকট বাড়ছে তো বাড়ছেই। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশ এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বাংলাদেশের জীবনযাত্রায় বিপুল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এক সময় যেখানে মানুষ বিনোদন বলতে সিনেমা হল বা টিভি দেখাকে বুঝত, এখন সেটি অনলাইন স্ট্রিমিং, গেমিং এবং সোশ্যাল মিডিয়া দখল করে নিয়েছে। ২০২৫ সালে মোবাইল ডাটার খরচ গড়ে পরিবারের মাসিক ব্যয়ের ৮ শতাংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনলাইন স্ট্রিমিং প্লাটফর্মে সাবস্ক্রিপশন খাতে ব্যয় বেড়েছে ১৫০ শতাংশ এবং স্মার্টফোন ও অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসের পেছনে ব্যয় আগের তুলনায় তিনগুণ বেড়েছে। এই পরিবর্তনটি তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব এবং ডিজিটাল সেবার প্রতি মানুষের আগ্রহের পরিচায়ক।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং নদীভাঙনের কারণে বহু পরিবার গৃহহীন হচ্ছে। কৃষিনির্ভর পরিবারগুলো আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন তাদের ব্যয়ের ধরন বদলে দিয়েছে। বন্যাপ্রবণ এলাকায় পরিবারগুলো পানির বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থা, বিকল্প জ্বালানি এবং বাড়ি মেরামতে বাড়তি খরচ করছে।
বাংলাদেশে গৃহস্থালি ব্যয়ের পরিবর্তন জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ এবং মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়নের একটি প্রতিচ্ছবি। শিক্ষায় অতিরিক্ত ব্যয়, স্বাস্থ্য খাতে চাপ এবং ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বেড়ানো খরচ, এসবই মানুষের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তনকে সূচিত করছে। পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জও এসেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সরকারের পরিকল্পিত নীতির প্রয়োজন। বিশেষ করে আয় বৈষম্য কমানো, নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনমান উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের উন্নয়নে সঠিক বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্রুত প্রসারের সাথে সাথে এই খাতগুলোতে আরও সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ আরও সমৃদ্ধ হতে পারে।
শুধু খাদ্য খাতে নয় সকল স্তরে দৈনন্দিন ব্যয় কমিয়ে জীবনযাত্রার মান সমুন্নত রাখার উপায় বের করতে হবে। কারণ জীবন এক মহাসমুদ্র। এখানে আকাক্সক্ষার ঢেউ আসে। অনাকাক্সক্ষার ঢেউ আসে। প্রয়োজনের জোয়ার ভাটায় মানুষ এগিয়ে চলে। আধুনিক নগর সভ্যতায় প্রতিদিনের ব্যয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে ব্যয়ের ভার কমিয়েও জীবনযাত্রার মানকে অবিকল রাখা সম্ভব। প্রয়োজন কৌশলী মনোভাব ও সঠিক পরিকল্পনা আর সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত।
আজকের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি দগ্ধ করছে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে। তারপরও অনেক দেশ দক্ষ জীবনব্যবস্থাপনায় উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। জাপানিরা বলে, “কাইজেন” অর্থাৎ ক্রমাগত উন্নতি। তারা জীবনের ছোট ছোট খাতে অপচয় কমিয়ে উদ্ভাবনী পথ বের করেছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে সাশ্রয়ী পরিকল্পনা ও ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে পরিবারের ৩২.৪৬% ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব। খাদ্যাভ্যাস জীবনের অন্যতম প্রধান ব্যয়ক্ষেত্র। সুস্বাস্থ্য এবং ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষায় স্থানীয় মৌসুমি খাবার গ্রহণ অত্যন্ত কার্যকর।
গবেষণা বলছে প্রসেসড ফুড বা আমদানিকৃত পণ্যের পরিবর্তে স্থানীয় খাদ্যপণ্য গ্রহণ ব্যয় কমায় ২০-২৫%। আবার নিজস্ব ছাদবাগান বা বারান্দার সবজি চাষ যেমন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করে, তেমনি খরচও কমায়। জীবনযাত্রার মানে প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য, তবে সচেতনতা জরুরি। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ ঘরে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য স্মার্ট হোম প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। আমাদের দেশে সোলার প্যানেলের ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। অপ্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বন্ধ রাখা প্রয়োজন। এ দুটি পদক্ষেপের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খরচ ১৫-২০% কমানো সম্ভব। আধুনিক সময়ে ‘রিইউজ, রিডিউস, রিদাইকেল’ এই তিনটি শব্দ হয়ে উঠেছে টেকসই জীবনযাত্রার মূলমন্ত্র।
পুরনো আসবাবপত্র বা পোশাক নতুন করে ব্যবহার করা কিংবা সংস্কার করাও ব্যয় কমানোর কৌশল। ইউরোপে জনপ্রিয় এই ধারাটি এখন বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিটি পরিবারে নানারকম ব্যয়ের গল্প থাকে। কখনও প্রয়োজনের গল্প কখনও আবেগের গল্প। পরিকল্পিত কেনাকাটা আবেগকে সংবরণ করে প্রয়োজনকে প্রাধান্য দেয়। ‘বাজেটিং’ কৌশলের মাধ্যমে মাসিক ব্যয়ের একটি হিসাব রাখলে অপ্রয়োজনীয় খরচ থেকে মুক্তি মেলে।
আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলেন এক মাসের বাজেটের ১০% জরুরি সঞ্চয়ে রেখে খরচ করা উচিত। পরিবহন একটি বড় ব্যয়ের খাত। ইউরোপের অধিকাংশ সাধারণ লোকজন বাইসাইকেল ব্যবহার করে। ফলে সেখানে মানুষ যেমন স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে তেমনি ব্যয়ও কমেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিবহন খাতে একসাথে অফিসযাত্রা বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ব্যবহার খরচ কমানোর কার্যকর উপায় হতে পারে। ব্যয় কমিয়ে জীবনযাত্রার মান ধরে রাখা মানে জীবনকে রঙিন করা থেকেও বিরত থাকা নয়। একটি ভালো বই, গান, অথবা প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানো জীবনকে আরও সুন্দর করে তুলতে পারে।
মন ও মস্তিষ্কে এই শান্তি ব্যয়ের চেয়েও বড় সম্পদ। দৈনন্দিন ব্যয় কমানোর এই কৌশলগুলো নিঃসন্দেহে জীবনযাত্রার মান সমুন্নত রাখে। আসন্ন ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা ও হতাশায় নিমজ্জনের হাত থেকে রক্ষা করে। কবির ভাষায়, “অল্পে তুষ্ট যে মন, সে-ই তো ধন্য।” প্রয়োজন পরিকল্পনা, সংযম, আর সাহসী সিদ্ধান্ত। তবেই আসবে নতুন ভোর, যেখানে প্রতিটি খরচ হবে এক একটি নতুন বিনিয়োগ।
লেখক: শিক্ষক, গবেষক ও সংগঠক
Comments