ছিলেন গৃহবধূ। নন সাধারণ গৃহবধূ; ছিলেন রাষ্ট্রপ্রধানের সহধর্মিণী। রাষ্ট্রপতি জীবিত থাকা অবস্থায় খুব বেশি সাধারণ্যে দেখা যায়নি তাকে। সর্বসাধারণের সামনে একেবারে সাধারণ বেশে দেখা গেল রাষ্ট্রপ্রধান শহীদ হওয়ার পরেই। একেবারে সাধারণ বেশে। ছোট দুজন ছেলে ও অতি সাধারণ গৃহবধূর অসাধারণ পথ চলার সেই শুরু। এ কথা সর্বজনবিদিত যে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মাত্র সাড়ে তিন বছরে গোটা দেশকে যে সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছিলেন সেটি এখনো রাজনীতিবিজ্ঞানের গবেষকদের বিস্ময়ের ব্যাপার।
রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি সেক্টরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্ভাবনার বীজ বপন করেছিলেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সেরকমই একটি বীজ।? জিয়াউর রহমান যখন শহীদ হন ১৯৮১-তে তখন সেই বীজ মাত্র প্রস্ফুটিত হয়েছে। বলা যায় দলের তখন শৈশব পর্বও আসেনি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সেই শৈশব পর্ব আসলে এসেছিল সেই সাধারণ গৃহবধূ বেগম জিয়ার হাত ধরে। দলের প্রয়োজনেই আশির দশকের প্রথমে রাজনীতিতে নামেন।
১৯৮২ সালের ১৬ ডিসেম্বর শৃঙ্খলিত গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে গৃহবধূ বেগম খালেদা জিয়া রাজপথে নামেন। শুরু করেন স্বৈরাচারবিরোধী আপসহীন সংগ্রাম। প্রায় নয় বছর অসীম সাহস, দৃঢ়তা, দ্রোহ ও একাগ্রতা দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে সংগঠিত করেছেন। সীমাহীন সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে স্বৈরাচারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নিব না এই প্রতিশ্রুতি থেকে তিনি কোনো অবস্থাতেই আপস করেননি। দলকে সংগঠিত করতে সেই আশির দশকে দলের ভেতরেও শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেছেন ‘দূষিত রক্ত বের করে দিয়েছি’!
দল কিন্তু তখন মাত্র শৈশব অবস্থা থেকে কৈশোরে পদার্পণ করেছে। এখনো ভাবতে অবাক লাগে কি সীমাহীন সাহস ও দৃঢ়তা থাকলে ওই অবস্থায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া যায়! বেগম জিয়ার অনমনীয় দৃঢ়তাতেই ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদের পতন হয়। শুরু হয় গণতন্ত্রের নবযাত্রা। ওয়ান ইলেভেন, ২০০৭ এরপরে গণতন্ত্র আবার শৃঙ্খলিত হয়।
বেগম জিয়া নিজে যেমন জেলে গিয়েছেন তেমনি তার দুই পুত্র জেলে গিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারপরও তিনি আপস করেননি। তাকে দেশের বাইরে পাঠানো প্রস্তাব দিলে তিনি দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা দেন- দেশের বাইরে তার কোনো ঠিকানা নাই, এই দেশেই তিনি থাকবেন। মূলত তার দৃঢ়তাতেই সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়ন হতে পারেনি। কিন্তু এরপর নির্বাচিত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তার জীবনের সবচাইতে বেদনবিধুর ও গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো।
এই পর্বে তিনি বাড়ি হারিয়েছেন, জেলে গিয়েছেন, এক পুত্র হারিয়েছেন, আরেক পুত্র নির্বাসনে থেকেছেন প্রায় ১৭ বছর। তারপরও তিনি মাথা নত করেননি, পরিণত হয়েছেন স্বৈরাচারবিরোধী জাতীয় প্রতীকে। এই পর্বে তার সংগ্রাম স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের সমার্থকে পরিণত হয়।
গৃহবধূ থেকে সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেত্রীতে পরিণত হওয়ার পূর্বে তিনি যেমন সাহস ও দৃঢ়তার অত্যুজ্জ্বল নজির স্থাপন করেছেন তেমনি পরিমিত শব্দ চয়নে এবং সর্বাবস্থায় সংযমের অভূতপূর্ব নজির স্থাপন করেছেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে। এই আশির দশক থেকে এই ২০২৫-এ এসে কেউ কখনোই বেগম জিয়াকে অপরিমিত শব্দচয়ন ও আচরণ করতে দেখেনি।
এইতো ৫ আগস্ট ২০২৪ তার কয়েক মিনিটের বক্তব্যটি দেখুন। ফ্যাসিস্ট সরকারের রোষানলে পড়ে তিনি গৃহহারা হয়েছেন, এক পুত্র হারিয়েছেন, নিজে জেলে গিয়েছেন, ন্যূনতম চিকিৎসা সুবিধা পাননি এবং এক ছেলে প্রায় দেড় যুগ বিদেশের মাটিতে অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রোপাগান্ডা মেশিন দিয়ে অহোরাত্রি কুৎসা রটনা করেছে।
হাজার হাজার নেতাকর্মীর গুম খুনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু তার বক্তৃতায় কোনো অভিযোগ নেই। বরং দেশবাসীর প্রতি ধৈর্য ধারণ করার উদার বার্তা দিয়েছেন। কী অসাধারণ উদার দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রজ্ঞা! তার রাষ্ট্রনায়কচিত ওই বক্তব্যের কারণেই দেশ রক্ষা পেয়েছে অরাজক পরিস্থিতি থেকে।
বেগম জিয়ার চরিত্রে সাহস ও সংযমের অবিচ্ছেদ্য সত্ত্বার সন্নিবেশ ঘটেছে। দেশের অনাগত ভবিষ্যতে যেকোনো সংকটে সংগ্রামে বেগম জিয়া জাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে থাকবেন। প্রিয় নেত্রী, যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। আপনি আমাদের জাতীয় জীবনে ধ্রুবতারা হিসেবে দেদীপ্যমান থাকবেন।




Comments