ব্যাংকিং খাত অর্থনীতির প্রাণ। দেশের আর্থিক খাত খুব একটা বড় নয়, পুঁজিবাজার দুর্বল, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতও শক্তিশালী নয়; সেকারণে অর্থের ৯০ শতাংশই ব্যাংক খাত থেকে আসে। স্বাধীনতার পর দেশের উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি করেছে এই ব্যাংক খাত। কিন্তু এই খাত ধীরে ধীরে দুর্বল হয়েছে। অর্থনীতিতে নতুন সরকারের নানা চ্যালেঞ্জ আছে। এগুলোকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছে। সরকার শক্ত হাতে এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে, অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরানোর বিষয়টি তার ওপর নির্ভর করছে।
দেশের মানুষের নৈতিক মানের অবক্ষয় হয়েছে, মূল্যবোধও কমে গেছে। ব্যাংকিং খাতের লোকজনদের মধ্যে এটি প্রকট। খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ব্যাংকিং খাতে চার ধরনের সমস্যা আছে। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা। সেটা হলো ব্যাংকিং খাতের যেসব নীতিমালা আছে, সেগুলো যথাযথভাবে পরিপালন করা হয় না। ক্যামেলস রেটিং অনুসারে ব্যাংকের স্বাস্থ্য পরিমাপের যেসব সূচক, যেমন মূলধন পর্যাপ্ততা, তারল্য, খেলাপি ঋণ, সম্পদ, ব্যবস্থাপনা, এসব ক্ষেত্রে নীতিমালা পরিপালিত হয় না। যদিও আলোচনা কেবল খেলাপি ঋণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ২০০৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা; ২০২৪ সালের জুন মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকায়। মূলধনের পর্যাপ্ততা আরেকটি বড় সমস্যা। আন্তর্জাতিক নীতিমালা বা ব্যাসেল অনুযায়ী যে পরিমাণ মূলধন থাকার কথা, তা কিন্তু সবাই মানতে পারে না। বিশেষ করে ১০-১২টি ব্যাংকের এই মূলধন অপর্যাপ্ততা আছে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা। আইনে যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকলেও বাস্তবে তা অতটা পরিপালিত হয় না। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সেই স্বাধীনতা প্রয়োগ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। গভর্নর নীতিপরায়ণ হলে তার আয়ত্তের মধ্যে যতটুকু স্বাধীনতা প্রয়োগ করা সম্ভব, তিনি ততটুকু করতে পারেন। কিন্তু সেটা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক আইনে বলা আছে, সরকারের কোনো কর্মকর্তা গভর্নর বা ডেপুটি গভর্নর হতে পারবেন না; কিন্তু পরপর দুজন গভর্নর আমলাতন্ত্র থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হোক। সেই সঙ্গে পরবর্তী কোনো রাজনৈতিক সরকার যেন এর পুনরাবৃত্তি করতে না পারে, সে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন টাস্কফোর্স করেছে, তারা এ লক্ষ্যে কাজ করবে বলে আশা করি। এছাড়া গত মে মাসে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করাসহ সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি দুই ধরনের হয়, এক ধরনের কোম্পানি দুর্বল ব্যাংকগুলোর সম্পদ অধিগ্রহণ করে এবং দুর্বল ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
আরেকটি হলো, দুর্বল ব্যাংকের সম্পদ কিনে পরবর্তীকালে ফেরত দেয়া হয়। তখন শঙ্কা থেকে যায়, আবারও সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সে জন্য এই কাজে আšর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নেয়া যেতে পারে। আরেকটি বিষয় আইনগত। অর্থঋণ আদালতে অনেক মামলা পড়ে আছে। প্রয়োজনীয় বিচারক নেই বলে মামলার কার্যক্রম চলে না। আদালতের বাইরে যে এই সমস্যার সমাধান করা হবে, তার উদ্যোগও নেই।
চতুর্থত, তথ্য প্রকাশ। ব্যাংকগুলো তথ্য প্রকাশ করে না; আগে এ বিষয়ে নজরদারিও করা হতো না। মামলা ও বিশেষ হিসাবে যে অর্থ আটকে আছে, সেগুলো বিবেচনায় নেয়া হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকা হতে পারে। যথাযথ তথ্য না থাকলে যথাযথ নীতি প্রণয়ন করা যাবে না। সামগ্রিকভাবে গড়পড়তা তথ্য পাওয়া যায়, কিন্তু ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। যেসব তথ্য দেয়া বাধ্যতামূলক, ব্যাংকগুলো তা দেয় না। সেই সঙ্গে ঋণ শ্রেণিকরণ, পুনঃতফসিল, অবলোপন এসব নিয়ম-কানুন বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে।
সর্বশেষ ২০২২ সালে এসব নিয়ম-কানুন শিথিল করা হয়েছে। এতে কী ফল হয়েছে, তা আমরা জানি না; কিন্তু যা হয়েছে, তা হলো সমস্যার স্তূপ তৈরি হওয়া। এসব খাতে আমাদের সংস্কার দরকার। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক সেই ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর একসময় অর্থনীতিবিদ হিসেবে যেসব কথা বলেছেন, এখন সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে অনেক ধরনের উদার নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতেও বিশেষ কাজ হয়নি; বরং এক ধরনের দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। আমরা দুর্বৃত্তায়নমুক্ত, সচল ও টেকসই ব্যাংকিং খাত দেখতে চাই। কিন্তু সমস্যা হলো, এই খাতে দীর্ঘদিন ধরে যে জঞ্জাল তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে এখন তা দূর করতে হচ্ছে। স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ দরকার। স্বল্পমেয়াদে বা তাৎক্ষণিকভাবে অনেকটা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার মতো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। যথাযথভাবেই তা নেয়া হচ্ছে।
ইতোমধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতকে অর্থনীতির মূল নিয়ামক হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে টেকসই ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প নেই। সে জন্য কাঠামোগত দুর্বলতা আমলে নিতে হবে। অর্থনীতি খারাপ হয়ে পড়লে সরকারের পতন হয়। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ, দুর্নীতি ও ভোটাধিকার হরণের কারণে সরকারের পতন হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে কিছু ভালো ব্যাংক দুর্বল হয়েছে। এক পরিবারের কাছে ৮-৯টি ব্যাংক তুলে দেয়া হয়েছে। ৪-৫টি পরিবার ব্যাংক থেকে ২ লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। বিস্ফোরণোন্মুখ এই অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করে যাচ্ছে। টাকা ছাপানো বন্ধ, সঙ্গে বন্ধ রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রিও। এই নীতি স্থিতিশীল হলে মূল্যস্ফীতি কমতে বাধ্য। এতে সবাই স্বস্তিতে থাকবে। ব্যাংক খাত সংস্কারে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে রাজনীতি ঠিক না হলে ব্যাংক খাতের সংস্কারগুলো টেকসই হবে না। সুতরাং সংস্কার উদ্যোগ টেকসই করতে হলে রাজনীতিতেও সংস্কার আনতে হবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কাজ, এ জন্য কোনো টাকা ছাপানো হচ্ছে না। শুধু পোশাক শ্রমিকদের বেতন দিতে এক হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। রিজার্ভ থেকেও ডলার বিক্রি করা হচ্ছে না। খোলাবাজারে ডলারের দাম ব্যাংকের চেয়ে কমে গেছে। এভাবে চললে বিনিময় হার স্থিতিশীল হয়ে যাবে। এখন যেসব ব্যাংকের টাকার প্রয়োজন হচ্ছে, তা না ছাপিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে যোগান দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। মানুষের ক্ষোভ ও কষ্ট কমাতে পারলে সেটা হবে বড় অর্জন। টাকা ছাপিয়ে সাময়িক স্বস্তি মিললেও সমস্যার সমাধান হবে না। মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। এজন্য টাকা না ছাপানো ও ডলার বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে । মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ যথাযথ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জায়গা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, সেগুলো ঠিক আছে। তবে শিল্পের কথা ভাবা হয়নি। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ৯ শতাংশ সুদে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করেছেন। এখন ব্যাংকঋণের সুদ সাড়ে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। সুদের হার আরও বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা কীভাবে ঋণের অর্থ পরিশোধ করবেন, সেটি ভাবা উচিত ছিল। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার কমানো হয়েছে। সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। ইডিএফ রপ্তানিকারকদের জন্য ভর্তুকি হিসেবে কাজ করছে। বিকল্প হিসেবে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা থাকলে সবাই সেটি নিতে পারবে না। ফলে রপ্তানি কমতে পারে।
ভবিষ্যতে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয় হবে ঋণের সুদহার। ১৫ শতাংশ ব্যাংকসুদে শিল্পকারখানা করে সফল হওয়া কঠিন। সুদহার বাড়লে সেটা ব্যাংকারদের জন্য খুশির খবর। কারণ, তাতে সুদ আয় বাড়বে। কিন্তু এর ফলে খেলাপি ঋণও বেড়ে যাবে। সুদহারের সঙ্গে বিনিয়োগের সম্পর্ক নেই। স্বাধীনতার পর দেশের উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি করেছে এই ব্যাংক খাত। কিন্তু এই খাত ধীরে ধীরে দুর্বল হয়েছে। সুদহারের কথা বলা হয়; এটা অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। কিন্তু সুদহারের সঙ্গে বিনিয়োগের সম্পর্ক তেমন একটা দেখা যায় না। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে অনেক ধরনের উদার নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতেও বিশেষ কাজ হয়নি; বরং এক ধরনের দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। আমরা এখন দুর্বৃত্তায়নমুক্ত, সচল ও টেকসই ব্যাংকিং খাত দেখতে চাই। স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ দরকার। এ জন্য সব লেনদেন বাজারভিত্তিক করা হচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা না ফিরলে বিনিয়োগ হবে না। এ জন্য ছয় মাস সময় দিতে হবে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের আকার কমানো হবে না। খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের আরেকটি সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে, তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বর্তমানে যে খেলাপি ঋণের কথা বলা হচ্ছে, সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে হবে। পৃথিবীর এমন কোনো ব্যাংক নেই, যেখানে খেলাপি ঋণ নেই। ইচ্ছাকৃত খেলাপি খারাপ। যারা অনিচ্ছাকৃত খেলাপি, তাদের সহায়তা করতে হবে, আর যারা ইচ্ছাকৃত তাদের শাস্তি দেয়া, জেলে নিতে হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে। খেলাপি ঋণ বেশি হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঋণ থেকে। কারণ, এ ধরনের বাণিজ্যের সব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক সংগ্রহ করে না। এর সূত্রপাত হয় ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র থেকে। এই বাণিজ্যেই ৭০-৮০ শতাংশ জালিয়াতি ও অর্থ পাচার হয়। বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক বেশি।
ব্যাংকিং নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের আশপাশের দেশ ও অঞ্চলের চর্চাগুলোকে আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন খাতের ভালো ও সফল উদ্যোক্তারা ব্যাংকের পরিচালনায় এসে আর ভালো কিছু করতে পারেন না। এর বড় কারণ রাজনৈতিক চাপ। এ ছাড়া বৈরী পরিবেশ ও নীতিও বড় কারণ। এমন একটি ব্যবস্থা করা দরকার, শুধু টাকা থাকলেই যে কেউ যাতে ব্যাংকের মালিকানায় চলে আসতে না পারে।
বিদায়ী সরকারের আমলে বাংলাদেশে অনেক ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও পর্ষদ সদস্য রাজনৈতিক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে কেউ কেউ এমন সুবিধা পেতেন যে সবাই সেই প্রতিযোগিতায় সক্ষম থাকতেন না। রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পাওয়া একটি পরিবার আট-নয়টি ব্যাংকের মালিকানা পেয়েছে। সেটি কীভাবে সম্ভব? অথচ বলা হচ্ছে, ব্যাংকে একটি পরিবারের শেয়ার ১০ শতাংশের বেশি হতে পারব না। রাজনৈতিক কারণে কিছু ভালো ব্যাংক দুর্বল হয়েছে। কিছু ব্যাংকের উদ্দেশ্য ভালো ছিল, কিন্তু নানা কারণে দুর্বল হয়েছে। এ জন্য ব্যাংকের পূর্বাবস্থা যাচাই-বাছাই করে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। একটু সহায়তা দিলে কিছু ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবেই। তাই ব্যাংক খাত সংস্কারে সময়ক্ষেপণ করা উচিত হবে না।
অবশ্যই দুর্বল ব্যাংককে সাহায্য করা দরকার। কিন্তু আমাদের ব্যাংককে যখন বিদেশি কোনো সংস্থা নিরীক্ষা করতে আসবে, তখন যদি দেখে কোনো তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই দুর্বল ব্যাংককে ঋণ দেয়া হয়েছে; তাহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কোনো ব্যাংক অর্থ ফেরত দিতে না পারলে গ্যারান্টার হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যাবে। এটা খুবই বিব্রতকর হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য। ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়া রাতের আঁধারে চূড়ান্ত করা হয়েছে। আইনটি আরও সংশোধন করে সমৃদ্ধ করা যায়। যদি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভালো হয় আর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ভালো না হয়, তাহলে সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে না। এই যে এতগুলো ব্যাংকে লুটপাট হয়ে গেল, সেখানে এমডিরা কী করেছেন? তাদের সততা কোথায় ছিল?
বর্তমানে ব্যাংক খাত যে অবস্থায় আছে, তাতে কিছু ব্যাংকের জন্য লভ্যাংশ বিতরণ কয়েক বছরের জন্য বন্ধ করে দেয়া দরকার। এ ছাড়া ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতেও বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। এই খাতের জন্য আলাদা কিছু নীতিও দরকার, যাতে প্রতিষ্ঠানগুলো ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বন্ধ করে দেয়ার কথা হয়েছে।
আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকতে হবে। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মতো আরেকটি বিভাগ থাকলে স্বার্থের গুরুতর সংঘাত সৃষ্টি হয়। ব্যাংক খাত রুগ্ন হয়ে পড়েছে। মানুষের মনে একধরনের ভীতি আছে। অনেকেই জানতে চান, কোন ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ? নতুন সরকার আসার পর মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হলেও অনিশ্চয়তার বোধ এখনো আছে। সে জন্য বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার। এ ছাড়া কোনো ব্যাংককে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, সে রকম পরিকল্পনা নেই। যত রুগ্নই হোক, কোনো ব্যাংককে মরতে দেয়া হবে না। সেটা হলে পরিষ্কার বার্তা দেয়া দরকার; তা না থাকলেও পরিষ্কার বলে দেয়া উচিত। সেই সঙ্গে শক্তিশালী ব্যাংক কোনগুলো, তা বলা উচিত।
রুগ্ন ব্যাংক টিকিয়ে রাখা হলে ভালো ব্যাংকেও এর প্রভাব পড়ে। এ খাত মানুষের আস্থার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ১০০ থেকে ১ হাজার টাকা ঋণ তৈরি হয়, অর্থাৎ পুরো বিষয়টি বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ভালো ব্যাংকও যেকোনো সময় ধসে যেতে পারে। সে জন্য সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে পরিষ্কার বার্তা থাকা উচিত, কোন ব্যাংকগুলো কী অবস্থায় আছে। ব্যাংক তদারকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও দক্ষতা দেখাতে হবে। আইন-কানুন পরিপালনে কাউকে ছাড় দিয়ে টিকিয়ে রাখার প্রথা তুলে নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিবেচনায় সব ব্যাংকের পরিচালকদের এক কাতারে রাখতে হবে। যখন যা সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন, তা নিতে হবে। তাহলে এর সুফল পাবে দেশের অর্থনীতি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট।
মানবকণ্ঠ/এফআই
Comments