
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতিই সভ্যতার উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে পারে না। একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই দেশের জনসাধারণকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। আমরা যেভাবেই চিন্তা করি না কেন, জাতিকে সভ্য ও মানবিক করে তুলতে হলে শিক্ষা লাগবেই। দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
অর্থাৎ একটা জাতিকে সম্মানের সাথে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে প্রথমেই যা প্রয়োজন তা হলো শিক্ষা। শিক্ষা শুধু জাতির উন্নয়ন ঘটায় না, ব্যক্তি যথা সমাজের চিত্রও বদলে দেয়। মানুষিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সৎ, সাহসী, দেশপ্রেমিক সর্বোপরি সভ্য নাগরিক গঠনে শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষার ধারাবাহিক প্রক্রিয়াটি শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর সমন্বিত চেষ্টায় প্রারম্ভিক পর্যায় থেকে উচ্চস্তরে পৌঁছায়।
এ জন্য দেশের সরকার বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চালায় রুটিন মাফিক। অনেক বড়ো অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে থাকে রাষ্ট্র। সব আয়োজন চলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্যই। যাতে করে তারা বড় হয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করতে পারে। দেশকে এগিয়ে নিতে পারে। আমরা জানি, বর্তমান প্রজন্মের হাতেই সমৃদ্ধ হবে আগামীর বাংলাদেশ। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় এই যে, বর্তমান সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে কঠিন এক দৈন্যদশার সৃষ্টি হয়েছে।
নানা কারণে আজ শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষ বিমুখ হয়ে পড়েছে। শিখন শেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে শিক্ষার্থীরা। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সবখানে শিক্ষায় অনাগ্রহ শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এর কিছু কারণ হতে পারে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবেশ পরিস্থিতিসহ শিক্ষার্থীর মানসিক উদাসীনতা। অভিভাবকের অসচেতনতাও এর অন্যতম কারণ।
এই ক্ষেত্রে বলা যায়, দেশের গ্রামাঞ্চলে এই অবস্থা কঠিন থেকে কঠিনতর আকার ধারণ করেছে। তুলনামূলকভাবে গ্রামের চেয়ে শহরের অভিভাবকগণ শিক্ষিত, সচেতন ও শিক্ষানুরাগী। ফলে শহরের তুলনায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। একসময় এমন ছিল যে, গ্রামের শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষায় বেশ সফলতার পরিচয় দিত। বুয়েট, মেডিকেল কলেজসহ উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রেও তাদের সাফল্য ছিল নজরকাড়ার মতো। কিন্তু ইদানীং সেই অর্জন শূন্যের কোঠায় না-নামলেও বড়ই হতাশাজনক।
এই পরিবর্তনের নানা কারণ রয়েছে। কিছু কারণের মধ্যে আছে- সামাজিক পরিবেশের বিপর্যয়, অভিভাবকের অসচেতনতা, আর্থিক অসচ্ছলতা, শিক্ষার্থীদের ঘোরাফেরার অবাধ স্বাধীনতা, মোবাইল গেমে আসক্ত, অসৎ সঙ্গ, শিক্ষার্থীদের অনীহা, সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব, বেকারত্বের ঝুঁকির চিন্তা, বাল্যবিবাহ, শিশুর পুষ্টিহীনতা, কৃষি কাজে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা, বর্ষাকালে যাতায়াতের সমস্যা। এছাড়াও শিক্ষিত ও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বীদের শহরের দিকে চলে যাওয়া, প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক না-থাকাসহ অন্যান্য কারণে শহরের তুলনায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছে।
তবে আজকাল বা সাম্প্রতিক সময়ে শহরের অবস্থাও ভয়াবহভাবে অবনতি ঘটেছে। শহরের স্বাধীনচেতা শিক্ষার্থীসহ অনেক শিক্ষার্থী সঙ্গদোষে নষ্ট হচ্ছে। শহরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে মাদকাসক্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে কিশোর গ্যাং-এ জড়িত হয়ে অনেক তরুণ বিপথগামী হয়ে পড়ছে। অনেক শিক্ষার্থী এভাবে শিক্ষা জীবন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন রকম আন্দোলন ও রাজনৈতিক কারণে শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ সময় শ্রেণিকক্ষের বাইরে থাকছে, ফলে লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ছে তারা। এছাড়া গ্রাম সম্পর্কে কমবেশি আমাদের সবার ধারণা আছে। আমরা জানি, অধিকাংশ গ্রামে মোড়ল বা গ্রাম প্রধানগণ একত্রিত বসে গ্রামের নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। তারা ছোট-খাটো ঝামেলা, বিচার-সালিশ নিজেরাই করে থাকেন।
সমাজের নানা আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপারেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে দেখা যায়। কখনো কখনো মতানৈক্যের কারণে মারামারি, ঝগড়া-বিবাদ এমনকি খুনের ঘটনাও ঘটে থাকে। তবে আর যা-ই হোক গ্রাম তথা এলাকার শিক্ষা উন্নয়ন নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না বললেই চলে। কয়েক বছর পরপর প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি গঠন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা প্রয়োজনে নির্বাচন এবং সেটা নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে হইচই, বিবাদ, মনোমালিন্য ইত্যাদি সংগঠিত হয়। এরপর একসময় গ্রামবাসীর এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা থাকে না। তখন কয়েকজন সদস্য স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে বহন করে মাসে-মাসে মিটিং আর আয়-ব্যয় হিসেব নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, শিক্ষার মান উন্নয়নে তাদের কোনো কার্যকর ভূমিকা চোখে পড়ে না।
বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি রাস্তার মোড়ে গড়ে উঠেছে চা-স্টল। সারাদিন এমনকি মধ্যরাত পর্যন্ত সেগুলোতে আড্ডা চলে। উচ্চ আওয়াজে টিভি চলে। গ্রামের অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত মানুষগুলো কাজ শেষে কেউ কেউ কর্ম বাদ দিয়ে এই দোকানগুলোতে পড়ে থাকে। সেই সাথে অনেক শিক্ষার্থী ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এসব আসরে বসে থাকে। কেউ কেউ মধ্যরাত পর্যন্তও কাটিয়ে দেয়।
আবার যারা বাড়িতে থেকে লেখাপড়ার টেবিলে বসতে যায় তারাও মনোযোগ দিতে পারে না পাশের গলির দোকান থেকে আসা টিভির আওয়াজে। এগুলো দেখার কেউ নেই, বলারও কেউ নেই। তাছাড়া গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের রয়েছে আর্থিক টানাপড়েন। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার পেছনে খরচ করার চেয়ে তারা জমি আবাদ ও গরু-ছাগলের পেছনে খরচ করতে বেশি উৎসাহী। পড়ে কী হবে? দেশে চাকরি নাই।
অভিভাবকের এমন মনোভাবের কারণেও গ্রামের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে সরে গিয়ে পিতার কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা কিছু কামাইরুজি শুরু করলেই তাদের বিয়ে দেয়া হচ্ছে। মেয়েদের অনিচ্ছায় এক প্রকার জোর করে বাল্যবিবাহ দেয়া হচ্ছে। সাংসারিক কাজে যুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন অনুপস্থিতির কারণে শিক্ষার্থীর অনীহা লক্ষ করা যাচ্ছে। একসময় ওই শিক্ষার্থী খেই হারিয়ে ফেলছে। এ অবস্থায় কোনো কোনো শিক্ষার্থীর অভিভাবক পুনরায় সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে আগ্রহ দেখালেও তা আর কাজে লাগছে না।
কেউ কেউ তখন ধর্মীয় শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীকে এতিমখানায় দিয়েও অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছেন। সঙ্গত কারণেই শহরের তুলনায় গ্রামের অভিভাবকের অসচেতনতা উল্লেখ করার মতো। সন্তানকে সঠিক দিকনির্দেশনা, চলাফেরায় লক্ষ রাখা, পুষ্টিকর খাবার দেয়া, হোমওয়ার্ক তৈরির তাগিদ ও প্রয়োজনে সহযোগিতা করা, ক্লাসে উপস্থিত নিশ্চিতকরণ, শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা ইত্যাদি ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোতে গ্রামের অভিভাবকগণ একেবারেই অজ্ঞ।
ফলে শহরের তুলনায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছে। আরও একটি বিষয় খেয়াল করার মতো, তা হলো গ্রামের মানুষের নানারকম দ্বন্দ্ব থেকে তৈরি হওয়া পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ শিক্ষিত, সচেতন, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী মানুষ গ্রাম ত্যাগ করে শহরের দিকে চলে যাচ্ছেন। ফলে শিক্ষার পরিবেশ আরও নাজুকভাবে অবনতি ঘটছে। কেননা, একজন সচেতন, শিক্ষিত, সভ্য মানুষের সংস্পর্শে আরও দশজন অনুরূপ মানুষ তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। আমরা আরও লক্ষ করছি যে, শহরের তুলনায় গ্রামের প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। যা শিক্ষা অবনতির অন্যতম কারণ। এই অবস্থা চলতে থাকলে গ্রামীণ শিক্ষা ব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতি হতে থাকবে। তাই এ থেকে উত্তরণের জন্য দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এখানে বলা যায় যে, সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রাথমিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে অভিভাবক বা মা সমাবেশ, উঠোন বৈঠক, নিয়মিত হোম ভিজিটসহ কিছু কার্যক্রম হয়ে থাকলেও গ্রাম পরিচালনাকারী প্রধানগণ এ বিষয়ে তৎপর না-হওয়ায় কাজের কাজ হচ্ছে না। ফলে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে বিঘ্ন ঘটছে। এ ব্যাপারে সরকারিভাবে সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম চালাতে হবে। এক্ষেত্রে গ্রামের বয়স্ক মানুষ, মোড়লগণ, সচেতন অভিভাবক, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও চাকরিজীবীদের সমন্বয়ে প্রত্যেক গ্রামে শিক্ষা কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
তারা শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে গ্রামকেন্দ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। গ্রাম প্রধানগণ গ্রামের অন্যান্য সালিশ বা বৈঠকের ন্যায় শিক্ষা বিষয়ক নানা বৈঠক পরিচালনা করে শিক্ষাক্ষেত্রে স্থানীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করার চেষ্টা করবেন। এ ব্যাপারে পার্শ্ববর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকগণকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারিভাবে গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। শিক্ষা অবনতির নানা কারণ এই লেখায় উল্লেখ করেছি।
দেশের অঞ্চলভেদে এই কারণগুলোর কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। এগুলো নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এখনই জরুরি বলে মনে করি। যেহেতু দেশের শতকরা প্রায় আশি ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করেন। সুতরাং সিংহভাগ শিক্ষার্থীর বসবাস গ্রামেই। শিক্ষার্থীদের এই বিশাল অংশ পিছিয়ে গেলে জাতি হিসেবে আমরা সম্মানের জায়গায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হবো।
পরিশেষে বলা যায়, দেশ তথা জাতিকে উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে হলে শিক্ষার দিকে নজর বাড়াতে হবে। কীভাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে মানসম্মত করা যায়, তা নিয়ে জোরালোভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সেই সাথে মনে রাখতে হবে যে, শুধু স্থাপনার উন্নতি নয়, চেতনায় উজ্জীবিত করে সভ্য জাতি গঠনের ক্ষেত্রে মনোযোগ আশু প্রয়োজন।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক, কবি ও কলামিস্ট
Comments