Image description

ছবি : আল জাজিরা

ভারত-চীন উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা লাদাখ হিমালয়ের উচ্চভূমি অঞ্চলটি জেন-জি প্রজন্মের তরুণদের নেতৃত্বাধীন সহিংস বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে। 

বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিক্ষোভকারীরা লাদাখের আঞ্চলিক রাজধানী লেহতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আঞ্চলিক কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করেন।

এই সংঘর্ষে কমপক্ষে চারজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে বিক্ষোভের সমন্বয়কারীরা আল-জাজিরাকে জানিয়েছেন। সংঘর্ষের পর সশস্ত্র বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সংঘর্ষে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্যও আহত হয়েছেন।

লাদাখে গত ছয় বছর ধরে স্থানীয় নাগরিক সংস্থাগুলোর নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও অনশন চালিয়ে আসছেন। তাদের মূল দাবি হলো, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে বিস্তৃত সাংবিধানিক নিরাপত্তা (ষষ্ঠ তফসিল) এবং পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করা। ২০১৯ সাল থেকে লাদাখ কেন্দ্রীয়ভাবে শাসিত হচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা চান, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষমতা তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।

সমাজসেবী, শিক্ষাবিদ ও পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুক জানান, বুধবার হতাশ ও ক্ষুব্ধ কিছু তরুণ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ থেকে বেরিয়ে এসে সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ওয়াংচুককে শুক্রবার ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে।

গ্রেপ্তারের আগে এক ভিডিও বার্তায় সোনম ওয়াংচুক বলেন, "এটা ছিল তরুণদের উন্মাদনা। একধরনের জেন-জি বিপ্লব, যা তাদের রাস্তায় নামিয়ে এনেছিল।" তিনি নেপালে চলতি মাসের শুরুতে জেন-জিদের বিক্ষোভে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির সরকারের পতনের মতো সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের কথা উল্লেখ করেন।

লেহেতে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় বুধবার সকালে, যখন স্থানীয় অধিকারকর্মীদের 'লাদাখ অ্যাপেক্স বডি'-এর নেতৃত্বে চলা অনশন ১৫তম দিনে প্রবেশ করে। মোদি সরকারের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের আলোচনা বিলম্বিত হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ ছিলেন। বুধবার সন্ধ্যায় দুই কর্মীকে হাসপাতালে ভর্তি করার ঘটনায় আয়োজকরা স্থানীয়ভাবে 'শাটডাউনের' ডাক দেন। 

অ্যাপেক্স বডির সমন্বয়ক জিগমত পালজর আল-জাজিরাকে বলেন, 'মানুষ পাঁচ বছর ধরে সরকারের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে ক্লান্ত এবং তারা বিক্ষুব্ধ ছিলেন।' তিনি এই দিনটিকে লাদাখের ইতিহাসে 'একটি ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী দিন' বলে অভিহিত করেন এবং জানান, তাদের সংগঠন সহিংসতার কারণে অনশন প্রত্যাহার করে শান্তির আহ্বান জানিয়েছে।

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, একদল 'বিশৃঙ্খল জনতার' সঙ্গে সংঘর্ষে ৩০ জনের বেশি নিরাপত্তাকর্মী আহত হয়েছেন এবং পুলিশকে আত্মরক্ষার জন্য গুলি ছুড়তে হয়েছে।  এতে কিছু 'হতাহতের ঘটনা' ঘটেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্ট করেছে, '(ওয়াংচুক) বিশৃঙ্খল জনতাকে উসকানি দিয়েছিলেন,' এবং তিনি 'আরব বসন্তের মতো বিক্ষোভ ও নেপালের জেন-জি বিক্ষোভের প্রসঙ্গ টেনে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন।' তবে ওয়াংচুক জোর দিয়ে বলেছিলেন, সরকার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের দাবি না মানলে তরুণদের ক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। তিনি নিজে কখনো সহিংসতার ডাক দেননি বলেও দাবি করেন।

২০১৯ সালে মোদি সরকার একতরফাভাবে ভারতের সংবিধানের একটি ধারা বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের আধা স্বায়ত্তশাসন ও রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেয়। সেই সময় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর উপত্যকা এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু অঞ্চলের সঙ্গে প্রায় সমান মুসলিম ও বৌদ্ধ জনসংখ্যা থাকা লাদাখকেও নিয়ে একটি অখণ্ড রাজ্য ছিল। মোদি সরকার সেই রাজ্যকে ভেঙে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে: জম্মু ও কাশ্মীর (যেখানে আইনসভা রয়েছে) এবং লাদাখ (যেখানে আইনসভা নেই)। 

স্থানীয় জনগণের মতে, জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ অন্তত স্থানীয় নেতা নির্বাচনের সুযোগ পেলেও, লাদাখবাসীর সেই সুযোগটি পর্যন্ত নেই। লাদাখ ভারতের প্রতিবেশী পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ চীন ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী একটি বিতর্কিত অঞ্চলে অবস্থিত। লাদাখের পূর্বে চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার।

অঞ্চলের আধা স্বায়ত্তশাসন এবং রাজ্যের মর্যাদা বাতিলের পর স্থানীয় নাগরিক সংস্থাগুলো নিয়মিত বিক্ষোভ মিছিল করেছে এবং কখনো কখনো অনশনও করেছে। লাদাখের বিক্ষোভের সর্বাধিক পরিচিত মুখ হলেন সোনম ওয়াংচুক, যিনি টেকসই উদ্ভাবনের জন্য আগে থেকেই জনপ্রিয়। তার জীবন থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে বলিউড ব্লকবাস্টার সিনেমা 'থ্রি ইডিয়টস' নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে 'র‍্যাঞ্চো' চরিত্রটি তাকে ঘিরেই বানানো হয়েছে। 

বিক্ষোভের প্রধান স্থান মার্টার্স মেমোরিয়াল পার্কের নাম রাখা হয়েছে লাদাখের তিন ব্যক্তির নামে, যারা ১৯৮৯ সালের আগস্টে কাশ্মীরিদের আধিপত্য নিয়ে স্থানীয়দের বিক্ষোভের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। অতীতে তফসিলি জাতিগোষ্ঠীর (শিডিউলড ট্রাইব) মর্যাদার দাবিতেও এখানে আন্দোলন হয়েছে। তবে বুধবারের বিক্ষোভ লাদাখের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল।