Image description

মাস খানেক আগের কথা। গণমাধ্যম পাড়ায় ছড়াল এক নিদারুণ খবর- খ্যাতিমান সাংবাদিক ও কলাম লেখক বিভুরঞ্জন সরকার নিখোঁজ। কয়েক ঘণ্টা পর জানা গেল, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার মেঘনা নদী থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এরপর একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত হলো বিভুরঞ্জন সরকারের শেষ লেখা 'খোলা চিঠি'। চিঠিতে তিনি নিজের অর্থনৈতিক দৈন্যদশাসহ আরও বেশকিছু অভিযোগের কথা উল্লেখ করেন। মূলত মানসিক চাপ, অর্থনৈতিক সংকট, কর্মজীবনের জটিলতা ও ব্যক্তিগত হতাশার জন্যই আত্মহননের পথ বেছে নেন এই পথিতযশা সাংবাদিক।

একইভাবে খুলনায় চলতি বছরের ৩১ আগস্ট সন্ধ্যায় রূপসা সেতু থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন সাংবাদিক বুলু। তিনি সংবাদ প্রতিদিনের খুলনা ব্যুরো প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ওয়াহেদ-উজ-জামান বুলু দীর্ঘ দিন ধরে পারিবারিক অশান্তিতে ভুগছিলেন এবং এবং অর্থ কষ্টেও ছিলেন।

এই দুটি ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই জামালপুরের ইসলামপুরে শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) ওসমান হারুনি নামের এক সাংবাদিকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওসমান হারুনি মোহনা টেলিভিশন ও দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ইসলামপুর প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পুলিশের ধারণা, দীর্ঘ দিন ধরে কিডনিজনিত অসুস্থতা, মানসিক চাপ ও আর্থিক সংকটের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ওসমান।

২১ জুন বরিশালে আর্থিক অনটনে চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে শাওন চক্রবর্তী নামের এক সংবাদকর্মী কীটনাশক পান করেন। পরদিন ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। শাওন বরিশালের উজিরপুর পৌর প্রেসক্লাবের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও উপজেলা পুরোহিত কল্যাণ সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

এই ঘটনাগুলো এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে আমাদের। ঘটনাগুলো কোনটিই আত্মহত্যা নয় বরং রাষ্ট্রযন্ত্র, সামাজিক ব্যবস্থাপনা ও গণমাধ্যম শিল্প সমন্বিতভাতে সংবাদ শিল্পী ও সাংবাদিকদের হত্যা করেছে। এ যেন প্রদীপের নিচে অন্ধকার, গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। সমাজের প্রতিচ্ছবি যেমন এখানে ফুটে ওঠে, তেমনই গণমাধ্যম সমাজের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। সাংবাদিকরা সেই দর্পণকে স্বচ্ছ রাখেন এবং পথের দিশা দেখান। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এক ভয়াবহ চিত্র আমাদের সামনে উঠে আসছে- অর্থাভাবে সাংবাদিকদের আত্মহত্যার ঘটনা। এটি যেন এক নীরব কান্না, যা সমাজের গভীরে বাসা বেঁধেছে।

সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে জনস্বার্থ, সত্য প্রকাশ এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। কিন্তু এই মহান পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরাই যখন জীবনধারণের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খান, তখন তা কেবল তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা থাকে না, বরং পুরো সমাজের জন্য এক অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের গণমাধ্যম শিল্পের কাঠামোগত দুর্বলতা এর অন্যতম প্রধান কারণ। অনেক ছোট ও মাঝারি আকারের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে ভোগে। বিজ্ঞাপনের স্বল্পতা, পাঠক বা দর্শক সংখ্যার অপ্রতুলতা এবং বিনিয়োগের অভাবের কারণে এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মীদের পর্যাপ্ত বেতন দিতে পারে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মাসের পর মাস বেতন বকেয়া থাকে। একজন সাংবাদিক যখন তার প্রাপ্য বেতন নিয়মিত পান না, তখন তার পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। বাড়ি ভাড়া, সন্তানের পড়াশোনার খরচ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম- সবকিছু মিলিয়ে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকে, যা শেষ পর্যন্ত হতাশা ও আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। সাংবাদিকদের চাকরির নিরাপত্তাহীনতা একটি বড় সমস্যা। অনেক সাংবাদিক অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করেন, যেখানে তাদের চাকরির কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। যেকোনো সময় কাজ হারানোর ভয় তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। বিশেষ করে মফস্বল পর্যায়ের সাংবাদিকদের অবস্থা আরও খারাপ। তাদের বেতন যেমন কম, তেমনই চাকরির অনিশ্চয়তা প্রবল। সাংবাদিকদের কাজের চাপ এবং মানসিক ধকল অত্যন্ত বেশি। তাদের সবসময় সংবাদের পেছনে ছুটতে হয়, তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংবাদ পরিবেশন করতে হয়। অনেক সময় তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও কাজ করতে হয়। এই বিপুল কাজের চাপ এবং মানসিক ধকলের পাশাপাশি যখন আর্থিক সংকট যোগ হয়, তখন পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে ওঠে। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সহায়তা পাওয়ার সুযোগও তাদের জন্য সীমিত। ফলে তারা একাকিত্ব এবং হতাশার গভীরে তলিয়ে যান। সামাজিক সম্মান এবং বাস্তবতার মধ্যে একটি বড় ফারাক তৈরি হয়েছে। সাংবাদিকতাকে সমাজে সম্মানের চোখে দেখা হলেও, বাস্তব জীবনে অনেক সাংবাদিকই আর্থিক সংকটের কারণে সামাজিক হেয় প্রতিপন্নতার শিকার হন। পরিবার এবং সমাজের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারার যন্ত্রণা তাদের পীড়া দেয়। বিশেষ করে যখন দেখা যায়, অন্যান্য পেশার মানুষরা ভালো বেতন পাচ্ছেন এবং সচ্ছল জীবনযাপন করছেন, তখন সাংবাদিকদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও বঞ্চনার অনুভূতি তৈরি হয়। এই হতাশা থেকেই অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং সংগঠনগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। যদিও সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে, তবে অনেক সময় তাদের পক্ষে সব সাংবাদিকের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে ছোট ও প্রান্তিক গণমাধ্যম কর্মীদের সমস্যাগুলো অনেক সময় চাপা পড়ে যায়। শক্তিশালী একটি সম্মিলিত উদ্যোগের অভাব পরিলক্ষিত হয়, যা গণমাধ্যম কর্মীদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। গণমাধ্যম মালিকপক্ষেরও এই দায়বদ্ধতা এড়ানোর সুযোগ নেই। কর্মীদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা তাদের নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্ব।

এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। গণমাধ্যম শিল্পে একটি সুষম আর্থিক কাঠামো তৈরি করতে হবে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে নজর দিতে হবে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কর্মীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো এবং নিয়মিত বেতন পরিশোধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি প্রণোদনা এবং বিজ্ঞাপন নীতিমালায় পরিবর্তন এনে ছোট ও মাঝারি গণমাধ্যমগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। সাংবাদিকদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। কাজের চাপ কমানো এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা জরুরি। প্রয়োজনে মনোবিদদের মাধ্যমে নিয়মিত কাউন্সেলিং সেশনের আয়োজন করা যেতে পারে। এই নীরব কান্না থামাতে হলে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। সরকার, গণমাধ্যম মালিক, সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং সাধারণ মানুষ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব। অন্যথায়, সাংবাদিকতা পেশার প্রতি মানুষের আস্থা যেমন কমবে, তেমনই সমাজের দর্পণ আরও ঘোলাটে হয়ে উঠবে। এই কলঙ্ক থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে হবে, যত দ্রুত সম্ভব।

ভূঁইয়া শফি : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক