Image description

বয়স ৯০ ছুঁইছুঁই। হাতে লাঠি, কাঁধে পুরোনো একটি ছেঁড়া ব্যাগ। তাতে কিছু প্লাস্টিক বোতল, ভাঙারি জিনিস যেগুলো বিক্রি করেই চলছে তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়। নাম তাঁর ছিয়ারুন বিবি। বাড়ি যশোরের খোলা ডাঙ্গা গ্রামে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় টুকু কাটিয়ে আজ অসহায়, দারিদ্র্য ও নিঃসঙ্গতার ভারে ন্যুব্জ এক মানুষ তিনি।

স্বামী খোরশেদ আলম মারা গেছেন বহু বছর আগে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে ছিল তাঁর আশ্রয়। ছোট ছেলে আলিম ট্রাক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান আট-দশ বছর আগে। বড় ছেলে সেলিম এখন আলাদা সংসার করে। মা আছেন তাঁর জীবনের বাইরের প্রান্তে। ছেলে সেলিম বেঁচে থাকলে সব কিছু দেখাশোনা করতো, বলেন গ্রামের মানুষ। কিন্তু আজ সেই মা একা।

১৯৮৩ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন যশোর জেলা কার্যালয়ে দৈনিক মজুরিভিত্তিক এক কর্মী হিসেবে যোগ দেন ছিয়ারুন বিবি। বেতন ছিল মাসে ১৫ থেকে ২০ টাকা। সরকারি পদ না হলেও, ফাউন্ডেশনের কাজের প্রতি তাঁর নিবেদন, সততা ও নিষ্ঠা ছিল অকল্পনীয়। অফিসের যাবতীয় ঝাড় পোঁছ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, কাগজপত্রের যত্ন করতেন এক হাতে। অফিসের সবাই তাঁকে ‘বিশ্বাসের মানুষ’ বলেই চিনতেন।

চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সেবা করেছেন। কিন্তু আজ, সেই প্রতিষ্ঠান থেকেও নেই কোনো আর্থিক সাহায্য, নেই পেনশন, নেই চিকিৎসা সহায়তা। ২০২৩ সালে তিনি সম্পূর্ণ শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন। তখন বাধ্য হয়ে ফাউন্ডেশনের কাজ ছাড়েন। বিদায়বেলায় সহকর্মীরা সামান্য কিছু টাকা তুলে হাতে দেন সেটুকুই তাঁর জীবনের একমাত্র ‘বি”েছদ উপহার’।

আজ ছিয়ারুন বিবি প্রতিদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। কখনও কারও দরজায় দাঁড়িয়ে বলেন, বাবা, একটু সাহায্য করো। কখনও ভাঙারি দোকানে প্লাস্টিক বোতল বিক্রি করেন। দিনশেষে যা পান, তাই দিয়ে কেনেন ভাত আর সামান্য ওষুধ। শরীর ভীষণ দুর্বল চলাফেরার জন্য লাঠিই এখন তাঁর একমাত্র ভরসা।

অফিসে মাঝে মাঝে আসেন, আগের পরিচিত মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। কেউ সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকালে বলেন, বাবা, একটু বকশিশ দাও, ওষুধ কিনবো। সেই অফিস, যেখানে একসময় তিনি প্রাণ ঢেলে কাজ করেছেন, আজ সেখানে তিনি কেবল করুণা প্রার্থনায় দাঁড়ানো এক বৃদ্ধা। রাষ্ট্র কি এই মানুষটার প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা অনুভব করে না? একজন নারী, যিনি সরকারি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সৎভাবে শ্রম দিয়ে গেছেন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা, আজ কেন তাঁকে রাস্তার ভাঙারি কুড়িয়ে বাঁচতে হবে? কেন নেই কোনো সামাজিক নিরাপত্তা, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা? 

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মোঃ ইকরামুল ইসলাম শাওন বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি, মাত্র দুই বছর হলো। ছিয়ারুন বিবির বিষয়টি জানার পর মানবিক দৃষ্টিতে দেখছি। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তাঁর পদ অনুমোদিত না হলেও আমরা বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করছি। 

হিসাবরক্ষক মোঃ অলিউর রহমান বলেন, ছিয়ারুন বিবি সরকারি নিয়মে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন না। তবে স্থানীয়ভাবে সম্মানিত কর্মী হিসেবে তাঁকে সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু বেতন দেওয়া হতো।

মানবিক বিবেচনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জেলা প্রশাসন কিংবা সমাজকল্যাণ ট্রাস্টের উচিত এমন মানুষের পাশে দাঁড়ানো। কারণ ছিয়ারুন বিবি কেবল একজন অসহায় বৃদ্ধা ননতিনি রাষ্ট্রের উপেক্ষিত শ্রমিকদের প্রতীক, যাদের ঘামেই দাঁড়িয়েছিল প্রতিষ্ঠানগুলো, অথচ বার্ধক্যে তারা ভুলে যাওয়া নাম হয়ে যায়। আজ প্রয়োজন একটি ছোট সহায়তা যাতে ছিয়ারুন বিবির শেষ জীবনে অন্তত ভিক্ষার ঝুঁলি নামিয়ে সামান্য মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারেন তিনি। জাতির কাছে প্রশ্ন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দরজায় একসময় যিনি সেবা দিয়েছিলেন, আজ সেই দরজায় তাঁর হাত কেন প্রসারিত ? কারণ তাঁদের জীবনের গল্পই আমাদের বিবেকের আয়না। 

ফিসের করিডোরে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা ছিয়ারুন বিবি যেখানে কাটিয়েছেন জীবনের সেরা দিনগুলো। হাতে ভাঙারি বোতল, মুখে মলিন হাসি এইভাবেই চলছে তাঁর সংগ্রামী জীবন।