সৈয়দপুর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের কুরআন শিক্ষার মক্তব
এক সময় সৈয়দপুরের গ্রামগঞ্জেও প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় থাকা কুরআন শিক্ষার মক্তব থেকে সকাল-সন্ধ্যায় ভেসে আসত আলিফ, বা, তা, সা আর কালিমা পাঠের মিষ্টি মধুর সুর। কচিকাঁচা বাচ্চাদের মুখ থেকে পবিত্র কুরআন পাঠের সেই আওয়াজে তখন মুখরিত থাকত মক্তবগুলো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে শিশুরা আরবি কায়েদা বা কুরআন বুকে নিয়ে মক্তবে ছুটে যেত। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন শিশুরা মক্তবে ছোটে না, ছোটে কোচিংয়ে কিংবা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। পিছনে একগাদা বইয়ের ব্যাগে অবুঝ শিশুগুলো এখন স্কুলের কঠিন পড়া মুখস্থ করতে ব্যস্ত। তাছাড়া গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ছিল, কুরআন শুদ্ধ করে পড়তে জানে এমন একটি মেয়েই হবে ঘরনি—যাতে বাড়ি-ঘর কুরআনের শব্দে বরকতময় হয়ে ওঠে। কিন্তু কালের বিবর্তনে বিভিন্ন কারণে এখন সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে মুসলিমপ্রধান এই দেশ থেকে। সৈয়দপুরও যার ব্যতিক্রম নয়। কালের বিবর্তনে সৈয়দপুরের গ্রামগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে কুরআন শিক্ষার সেই মক্তবগুলো। সৈয়দপুর উপজেলার গ্রামগঞ্জ ঘুরে দেখা মিলেছে এমনই চিত্র।
উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের ধলাগাছ মুন্সিপাড়া এলাকা, খাতামধুপুর ইউনিয়নে থাকা বেশ কয়েকটি মক্তবগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কোথাও কোথাও যা চালু আছে, সেগুলোতেও নেই আগের মতো জৌলুস। শিশুদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। নামে-মাত্র চলে এসব কুরআন শিক্ষার পাঠশালা। তবে উপজেলার বিভিন্ন মসজিদে সকাল-সন্ধ্যায় শিশুদের স্বেচ্ছায় কুরআন শিক্ষা দিয়ে এই ধারা কোনোমতে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা।
তেমনই চিত্র দেখা গেল ঐতিহাসিক চিনি মসজিদের বারান্দায়। সেখানে সকালে ও বিকেলে কিছু শিশুদের নিয়ে কুরআন শিক্ষা দিচ্ছেন হাফেজ আরিফ রেজা। তিনি জানান, মক্তব আর নেই। তাই নিজ দায়িত্ববোধ থেকে মসজিদের বারান্দায় শিশুদের কুরআন শিক্ষা দিচ্ছি।
মক্তব আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ পাঠশালা। শিশুদের কুরআন শিক্ষার এবং ইসলাম সম্পর্কে প্রাথমিক মৌলিক জ্ঞানার্জনের উত্তম শিক্ষাকেন্দ্র এ কুরআনি মক্তব। এখান থেকে শিশুরা কুরআনের তিলাওয়াত শেখার পাশাপাশি নামাজ-রোজার নিয়ম-কানুন, জরুরি মাসআলা-মাসায়েল, দোয়া-কালাম ইত্যাদি শিখতে পারত। কিন্তু আস্তে আস্তে এসব কুরআনি মক্তবগুলো বিলীন হওয়ার কারণ কী? বর্তমানে শিশুদের বাড়তি বইয়ের বোঝা, আবার কখনো কিন্ডারগার্টেনের বিরূপ প্রভাব—এ নিয়ে শহরের বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদরা জানালেন বিভিন্ন কারণ।
সৈয়দপুরের ঐতিহাসিক চিনি মসজিদের ইমাম ও খতিব হাফিজ মাওলানা শাহিদ রেজা রিজভী বলেন, কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের ওপর বাড়তি পড়ার চাপের ফলে গ্রামগঞ্জ থেকে কুরআন শিক্ষার জৌলুস হারাচ্ছে। সকালে যে সময় শিশুরা আরবি কায়েদা শেখার জন্য বের হতো, আজ সেই সময় শিশুদের কাঁধে বিশাল বইয়ের বোঝা। ফলে আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে আরবি শিক্ষা আর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কুরআনি মক্তবগুলো। এভাবে চলতে থাকলে ইসলামি বুনিয়াদি শিক্ষার এ অবারিত ও ঐতিহ্যগত মক্তবি প্রতিষ্ঠান চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে। পরিণত হতে পারে অতীত ইতিহাস।
সৈয়দপুরের বিশিষ্ট তরুণ আলেমদ্বীন মুফতি শাহজাদা আশরাফী জানান, আজ ডিজিটালাইজডের বিরূপ প্রভাব পড়েছে সমাজের বেশিরভাগ পরিবারে। অনেকাংশে অভিভাবকরাও দায়ী এক্ষেত্রে। মসজিদের ইমামগণ মক্তবে কুরআন শেখানোর আগ্রহ দেখালেও শিশুদের অধিকাংশ অভিভাবকদের এতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা চিন্তা করে, তাদের শিশুরা স্কুলে যাবে, ইংরেজিতে কথা বলবে। মক্তবে গিয়ে অহেতুক সময় নষ্ট করার কী দরকার? এ ধরনের চিন্তা অনেকাংশে আজ গ্রামগঞ্জের মক্তবগুলোকে মৃত করে রেখেছে।
তবে সময়ের পরিবর্তনে মক্তব হারিয়ে গেলেও সৈয়দপুর উপজেলার বিভিন্ন মসজিদে শিশুদের কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করে মসজিদভিত্তিক মক্তব টিকিয়ে রেখেছে কুরআন পাঠের এই শিক্ষাব্যবস্থা। উপজেলার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, গোলাহাট জামে মসজিদ, টালি মসজিদ, বড় মসজিদ, চিনি মসজিদ, ধলাগাছ বাইতুস সালাম মসজিদসহ গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে দেখা গেছে, মসজিদের বারান্দায় কচিকাঁচা শিশুরা কুরআন কায়েদা পাঠে ব্যস্ত। মূলত ফজর এবং আসরের পর এসব মসজিদে স্বেচ্ছায়, আবার কখনো ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে দেওয়া হয় কুরআন শিক্ষা।
তবে সেখানেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে—এমনটাই জানালেন সৈয়দপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের শিশুদের কুরআন পাঠদানকারী শিক্ষক মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ নুরী। এ সময় মক্তব হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবই সময়ের পরিবর্তন।
ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের মাত্রাতিরিক্ত শিক্ষাদানের কারণে মক্তব হারিয়ে যাওয়ার কারণ বলে মনে করেন সৈয়দপুরের অধিকাংশ মসজিদের ইমাম ও ইসলামী চিন্তাবিদরা।
তবে মক্তব ব্যবস্থা কি বর্তমানে আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব? এমন প্রশ্নের উত্তরে সৈয়দপুরের প্রবীণ ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা মোহাম্মদ আলী মিসবাহী জানান, সবকিছু নির্ভর করছে সদিচ্ছা এবং সহযোগিতার ওপর। মক্তব চলে পাড়াপড়শিদের দান-খয়রাতে। আমরা অবশ্যই চাইব গ্রামগঞ্জে আবার প্রতিটি মক্তবে ভেসে উঠুক কুরআন পাঠের মধুর সুর। এক্ষেত্রে আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে সরকারের যেমন এগিয়ে আসা উচিত, তেমনি সমাজের বিশিষ্টজনদেরও উচিত যেখানে যেখানে বিলীন মক্তবগুলো পড়ে আছে, সেগুলোকে সচল করতে এগিয়ে আসা। তবে এখানে মুখ্য ভূমিকা অভিভাবকের। অভিভাবক সচেতন মানে মক্তব সচল।




Comments