Image description

শরতের স্নিগ্ধ আলো আর মৃদু হাওয়ায় যখন প্রকৃতি ধীরে ধীরে নতুন রূপে সেজে ওঠে, তখনই যমুনার তীর যেন সাদা স্বপ্নে মোড়ানো এক অপার্থিব রাজ্যে পরিণত হয়। এক পাশে শান্ত নীরব যমুনা নদী, অন্য পাশে দিগন্তজোড়া সাদা কাশফুল—দেখলে মনে হয় প্রকৃতি যেন নিজের আঁচল ভরে তুলেছে সাদার মায়ায়।

সিরাজগঞ্জ কাজীপুরের চর-গিরিশ এলাকায় এখন চলছে সেই সাদার উৎসব। প্রতি বছরের মতো এবারও শরতের আগমনে নদীর পাড়জুড়ে ফুঁটেছে কাশফুলের মেলা। যেন যমুনার বুকে বসেছে এক অনন্ত কবিতার আসর—যেখানে বাতাসও গেয়ে ওঠে শরতের সুর, আর ফুলের দোলায় হারিয়ে যায় ক্লান্ত মন।

দূর থেকে তাকালে মনে হয় নদীর তীরে বিছানো সাদা চাদর, যার একপ্রান্তে সবুজ চর আর অন্যপ্রান্তে নীল আকাশের প্রতিফলন। বিকেলের শেষ রোদে যখন সূর্যের আলো পড়ে কাশফুলের উপর, তখন সেগুলো যেন সোনালি ঝিলিক ছড়িয়ে দেয় চারপাশে।

রোববার (৯ নভেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় এক কিলোমিটারজুড়ে কাশফুলের সমারোহ। হালকা বাতাসে দুলছে ফুলের শীষ, মাঝে মাঝে উড়ে যাচ্ছে বকের ঝাঁক। বাতাসে মিশে আছে নদীর ঠান্ডা সুবাস আর ফুলের মিষ্টি গন্ধ।

দর্শনার্থীদের মধ্যে কেউ মুঠোফোনে বন্দি করছেন সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, কেউ আবার প্রিয়জনের সঙ্গে ফুলে ঘেরা সরু পথে হাঁটছেন হাত ধরে। শিশুদের কোলাহলে মুখর পুরো এলাকা। কেউ লুকোচুরি খেলছে কাশবনের ভেতর, কেউ ছিঁড়ে নিচ্ছে কিছু ফুল—তোড়া বানানোর জন্য।

স্থানীয়রা বলছেন, আগে এমন ভিড় দেখা যেত না। ভাদ্রের শেষ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত কাশফুল ফোটে। একসময় এই সৌন্দর্য শুধু গ্রামবাসীর চোখেই ধরা দিত, এখন তা শহরজুড়ে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।

বাদাম বিক্রেতা রৌফ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই এই চরেই বড় হয়েছি। আগে মানুষ তেমন আসত না। এখন বিকেল হলেই ভিড় জমে। অনেকে ছবি তোলে, ভিডিও করে। আমার মতো বিক্রেতারও ভালো ব্যবসা হয়।’

স্থানীয় তরুণ রিফাত হোসেন বলেন, ‘আমাদের এলাকায় এরকম জায়গা আছে, এটা অনেকেই জানত না। এখন ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে ছবি ভাইরাল হচ্ছে, ফলে অনেক মানুষ ঘুরতে আসছে।’

প্রকৃতিপ্রেমীরা বলছেন, চর-গিরিশ কাশবন শুধু সৌন্দর্যের নয়, পর্যটনেরও বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করেছে। যমুনার পাড়ে এমন একটি প্রাকৃতিক দৃশ্য সারা বছর পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে যদি তা পরিকল্পিতভাবে সংরক্ষণ করা যায়।

স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘কাশফুল তো শরতের প্রতীক, কিন্তু আমাদের এখানে এটি একটি প্রাকৃতিক ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। যদি স্থানীয় প্রশাসন একটু উদ্যোগ নেয়—বসার জায়গা, আবর্জনা ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে—তাহলে এটা হতে পারে সিরাজগঞ্জের একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে।’

তবে স্থানীয়রা উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন। দর্শনার্থীদের ফেলা প্লাস্টিক ও খাবারের প্যাকেটের কারণে ধীরে ধীরে দূষণ বাড়ছে। কেউ কেউ কাশফুল ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে বালতি ভরে, যা ভবিষ্যতে ফুলের ক্ষতির কারণ হতে পারে।

সন্ধ্যা নামলে অন্যরকম রূপ নেয় পুরো চর। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডোবে, তার ঠিক পরেই নদীর জলে ঝিলমিল করে ওঠে চাঁদের আলো। কখনো মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দেয় সেই রুপালি চাঁদ, আবার কখনো লুকিয়ে যায়। যমুনার জলে তখন মনে হয়, ভাসছে হাজারো কাচের টুকরো।

দূরে ভেসে আসে বাদামের ঠেলা গাড়ির ঘণ্টা, কোথাও শোনা যায় তরুণদের হাসির শব্দ। চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেদ করে তখন মনে হয়, প্রকৃতি যেন নিজের সুরে গাইছে শরতের গান—কাশফুলের রাজ্যে এক মায়াময় আহ্বান।

শুধু ফুল নয়, কাশফুল যেন শরতের পরিচয়পত্র। বৃষ্টিভেজা আষাঢ়-শ্রাবণের শেষে যখন মাটি শুকোতে শুরু করে, তখন কাশফুলের ফোটা জানিয়ে দেয় নতুন ঋতুর আগমন। তার সাদা শীষে মিশে থাকে শান্তি, ভালোবাসা আর জীবনের সহজ সৌন্দর্য।

যমুনার পাড়ের এই কাশফুল তাই কেবল প্রকৃতির উপহার নয়—এ যেন নদী, মাটি আর মানুষের এক মেলবন্ধন। শরতের এই ফুল মানুষকে শেখায় এক চিরন্তন সত্য—প্রকৃতি যতই বদলাক, তার সৌন্দর্যের ভাষা সবসময় একই থাকে—সাদার মায়ায় মোড়া নির্মল হাসি।