দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা বেক্সিমকো টেক্সটাইল ডিভিশন আবারও আলোর মুখ দেখতে চলেছে। জাপান-বাংলাদেশি ইথিক্যাল ফ্যাশন ও সাসটেইনেবিলিটি প্রতিষ্ঠান 'রিভাইভাল গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড' ও 'রিভাইভাল প্রজেক্টস লিমিটেড'-এর হাত ধরে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি পুনরায় উৎপাদনে ফিরছে, যা প্রায় ২৫ হাজার কর্মীর জন্য নতুন আশার সঞ্চার করবে। এটি দেশের শিল্পখাতে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থান পুনরুদ্ধারের ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
রিভাইভাল প্রজেক্টস লিমিটেড, জনতা ব্যাংক এবং বেক্সিমকোর মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় লিজ চুক্তির খসড়া গত ৮ অক্টোবর জমা দেওয়া হয়েছে। আগামী মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) জনতা ব্যাংকের বোর্ড সভায় এই খসড়া পর্যালোচনা করা হবে এবং সম্ভাব্যভাবে চলতি মাসেই চুক্তিটি সই হওয়ার কথা রয়েছে। এই চুক্তি স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিতে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে রিভাইভাল ও ইকোমিলির শীর্ষ কর্মকর্তারা ঢাকায় আসছেন।
কারখানাটি পুনরায় চালু হলে ২৫ হাজারেরও বেশি শ্রমিক তাদের হারানো কর্মসংস্থান ফিরে পাবেন। এই বিশাল সংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থান ফিরে পাওয়া দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এই প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইকোমিলি, যা প্রবাসী বাংলাদেশিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। প্রাথমিকভাবে ২০ মিলিয়ন ডলারের ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধা দেওয়া হবে, যা প্রয়োজন অনুযায়ী ১০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে।
একসময় দেশের টেক্সটাইল খাতের অন্যতম শীর্ষ উৎপাদন কেন্দ্র ছিল বেক্সিমকো টেক্সটাইল। তিন দশক সফলভাবে উৎপাদনের পর ঋণসংকটে পড়ে এটি বন্ধ হয়ে গেলে হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারান এবং আশপাশের এলাকার অর্থনীতিতেও ধস নামে। রিভাইভালের এই নতুন বিনিয়োগ সেই বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর এক বিশাল সুযোগ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
রিভাইভাল জানিয়েছে, তারা কারখানাটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করবে, পুরোনো ব্যবস্থাপনা দলকে ফিরিয়ে আনবে এবং আগের শ্রমিকদের পুনর্বহাল করবে। জাপানি-বাংলাদেশি মালিকানার কারণে জাপানের শৃঙ্খলাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে জাপান থেকে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের আনা হবে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য একটি বৈশ্বিক বিগ ফোর অডিট ফার্ম নিয়োগের পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের।
রিভাইভালের লক্ষ্য শুধু উৎপাদন নয়, বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও ফ্যাশন শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি রূপান্তর আনা। তারা বেক্সিমকোর পূর্বের আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ পুনরায় স্থাপন করবে এবং নতুন বৈশ্বিক অংশীদারদের যুক্ত করবে। তাদের স্লোগান—‘লোকালি ডিজাইন, সেল গ্লোবালি’—এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে সৃজনশীলতা ও ডিজাইন-ভিত্তিক ব্র্যান্ড উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখছে রিভাইভাল।
এই লক্ষ্যে দেশে উন্নতমানের প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেট কোর্স এবং তরুণদের জন্য প্রথমবারের মতো একটি পূর্ণাঙ্গ ডিজাইন ইনস্টিটিউট গড়ার ঘোষণাও দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিশেষজ্ঞরা সেখানে প্রশিক্ষণ দেবেন।
রিভাইভালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা হুদা মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, "এটি শুধু একটি কারখানার পুনরায় চালু নয়—হাজারো পরিবারের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ।" ইকোমিলির প্রেসিডেন্ট ড. ফারহান এস. করিম এটিকে 'ব্রেইন ড্রেইনের গল্প নয়, ব্রেইন গেইনের গল্প' বলে অভিহিত করেছেন। বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী রিভাইভালের এই উদ্যোগকে কারখানার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বেক্সিমকো টেক্সটাইলকে উৎপাদনে ফেরানোর পরিকল্পনা রয়েছে রিভাইভালের। তারা আশা করছে, ২০২৭ সালের মধ্যে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন সম্ভব হবে, যা বকেয়া ঋণ পরিশোধ এবং শিল্পটির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে।




Comments