সৃষ্টির সেবা ও জীবের প্রতি দয়া প্রদর্শন ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য। ইসলাম কেবল মানুষের অধিকার নিয়েই কথা বলে না, বরং অবলা প্রাণীর অধিকার ও তাদের প্রতি আচরণের বিষয়েও কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে। সম্প্রতি পাবনার ঈশ্বরদীতে আটটি কুকুর ছানাকে বস্তাবন্দি করে পুকুরে ডুবিয়ে হত্যার যে পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছে, তা কেবল মানবতার চরম অবমাননাই নয়, বরং ইসলামের দৃষ্টিতে এক ভয়াবহ গুনাহ ও জঘন্য অপরাধ।
সৃষ্টির প্রতি দয়া: ঈমানের অংশ
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজেকে ‘আর-রাহমান’ ও ‘আর-রাহিম’ (পরম করুণাময় ও দয়ালু) হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। আর আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে পাঠানো হয়েছে ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ বা সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমত হিসেবে। এই রহমত বা দয়া কেবল মানুষের জন্য সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতিটি প্রাণীর জন্য।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন,
“দয়াকারীদের ওপর রহমান (আল্লাহ) দয়া করেন। তোমরা পৃথিবীবাসীর ওপর দয়া করো, তবে আসমানওয়ালা (আল্লাহ) তোমাদের ওপর দয়া করবেন।” (তিরমিজি: ১৯২৪)
সুতরাং, যে ব্যক্তি অবলা প্রাণীর ওপর নির্দয় আচরণ করে, সে মূলত আল্লাহর রহমত থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে।
প্রাণী হত্যার ভয়াবহ পরিণতি: হাদিসের সতর্কবার্তা
ঈশ্বরদীর ঘটনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় হাদিসে বর্ণিত সেই নিষ্ঠুর নারীর কথা, যাকে কেবল একটি প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতার কারণে জাহান্নামী সাব্যস্ত করা হয়েছিল।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
“এক নারীকে একটি বিড়ালের কারণে শাস্তি দেওয়া হয়েছে (জাহান্নামে দেওয়া হয়েছে)। সে বিড়ালটিকে বেঁধে রেখেছিল এবং শেষ পর্যন্ত সেটি মারা গিয়েছিল। সে বিড়ালটিকে পানাহার করায়নি, আবার ছেড়েও দেয়নি যাতে সে জমিনের পোকা-মাকড় খেয়ে বাঁচতে পারে।” (বুখারি: ৩৪৮২)
যদি একটি বিড়ালকে না খাইয়ে মারার কারণে জাহান্নামের শাস্তি অবধারিত হয়, তবে আটটি সদ্যোজাত কুকুর ছানাকে জীবন্ত বস্তাবন্দি করে পানিতে ডুবিয়ে মারার শাস্তি কতটা ভয়াবহ হতে পারে—তা সহজেই অনুমেয়।
প্রাণীর সেবা: জান্নাত লাভের মাধ্যম
অন্যদিকে, প্রাণীর প্রতি সামান্য দয়া প্রদর্শনের কারণে আল্লাহ পাপিষ্ঠ বান্দাকেও ক্ষমা করে দিতে পারেন। হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি চরম তৃষ্ণার্ত অবস্থায় একটি কুকুরকে কাদা চাটতে দেখে নিজের মোজায় পানি ভরে তাকে পান করিয়েছিল। এই আমলটি আল্লাহর কাছে এত প্রিয় ছিল যে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন এবং জান্নাতবাসী করলেন। (বুখারি ও মুসলিম)
অহেতুক হত্যা ও কষ্ট দেওয়া হারাম
ইসলামে বিনা কারণে কোনো প্রাণীকে হত্যা করা, কষ্ট দেওয়া বা তার অঙ্গহানি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি প্রয়োজনের ক্ষেত্রে (যেমন হালাল পশু জবাই) পশুকে কষ্ট না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর কুকুর বা অন্য কোনো প্রাণী যদি ক্ষতিকর না হয়, তবে তাদের হত্যা করা সম্পূর্ণ হারাম।
রাসূল (সা.) কোনো প্রাণীকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তীর বা কোনো কিছু ছোড়ার অনুশীলন করতেও নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন,
“যে ব্যক্তি অহেতুক কোনো চড়ুই পাখি বা তার চেয়ে ছোট কোনো প্রাণীকে হত্যা করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন।” (নাসায়ি: ৪৪৪৫)
মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব (আশরাফুল মাখলুকাত)। মানুষের দায়িত্ব হলো আল্লাহর সৃষ্টিকে ভালোবাসা এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করা। ঈশ্বরদীতে যারা এই নির্মম কাজটি করেছে, তারা মানুষ নামের কলঙ্ক। সামাজিকভাবে যেমন এদের বিচার হওয়া জরুরি, তেমনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এদের তওবা করা আবশ্যক। কারণ, বান্দার হক বা সৃষ্টির হকের ব্যাপারে আল্লাহ অত্যন্ত কঠোর।
অবলা প্রাণীদের ভাষা নেই, তারা মানুষের কাছে বিচার চাইতে পারে না। কিন্তু তাদের স্রষ্টা সব দেখেন। কিয়ামতের দিন এই নির্বাক প্রাণীগুলো আল্লাহর দরবারে তাদের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে নালিশ করবে।
আসুন, আমরা আল্লাহর সৃষ্টিকে ভালোবাসি। অবলা প্রাণীদের প্রতি সদয় হই। মনে রাখতে হবে, প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা আমাদের পরকালীন জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে, আর তাদের প্রতি সামান্য দয়া আমাদের জন্য জান্নাতের পথ সুগম করতে পারে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং সৃষ্টির প্রতি দয়াশীল হওয়ার তৌফিক দিন। আমিন।
Comments