Image description

মানুষ সামাজিক জীব। বিপদ-আপদে একে অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়, আর এই সহযোগিতার অন্যতম মাধ্যম হলো ‘ঋণ’ বা ‘কর্জ’। ইসলামে ঋণ আদান-প্রদান বৈধ এবং এটি একটি ইবাদতও বটে, যদি তা আল্লাহকে খুশি করার জন্য হয়। তবে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে ইসলাম অত্যন্ত কঠোর মনোভাব পোষণ করে।

ঋণ পরিশোধের আবশ্যকতা ও সতর্কতা

ইসলামে ঋণকে ‘আমানত’ হিসেবে গণ্য করা হয়। সামর্থ্য থাকার পরও ঋণ পরিশোধে টালবাহানা করাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) ‘জুলুম’ বা অত্যাচার বলে আখ্যায়িত করেছেন।

  • শহীদেরও মাফ নেই: আল্লাহর রাস্তায় জীবন দেওয়া (শহীদ হওয়া) ইসলামের সর্বোচ্চ ত্যাগের নিদর্শন। হাদিসে এসেছে, শহীদের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে, কিন্তু ঋণ মাফ হবে না (সহিহ মুসলিম)।

  • জানাজা ও রুহের অবস্থা: রাসুলুল্লাহ (সা.) ঋণী ব্যক্তির জানাজা পড়তেন না, যতক্ষণ না তার ঋণের জিম্মাদার কেউ হতেন। তিনি বলেছেন, “মুমিন ব্যক্তির রুহ তার ঋণের সাথে ঝুলন্ত থাকে (জান্নাতে যেতে পারে না), যতক্ষণ না তা পরিশোধ করা হয়” (তিরমিজি)।

ঋণদাতার ফজিলত ও সওয়াব

ঋণগ্রহীতার ওপর যেমন চাপ থাকে, ঋণদাতার জন্য রয়েছে বিশাল পুরস্কার।

  • দান বা সদকার চেয়েও উত্তম: রাসুল (সা.) মিরাজের রাতে জান্নাতের দরজায় লেখা দেখেছিলেন—সদকার সওয়াব ১০ গুণ, আর কর্জ বা ঋণের সওয়াব ১৮ গুণ। কারণ, ঋণগ্রহীতা নিতান্ত বাধ্য হয়েই হাত পাতে।

  • কিয়ামতের ছায়া: যে ব্যক্তি কোনো অভাবী ঋণগ্রহীতাকে সময় দেয় অথবা ঋণ মাফ করে দেয়, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন নিজের আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন (সহিহ মুসলিম)।

একটি শিক্ষণীয় ঘটনা: ১০০০ দিনার ও কাঠের টুকরো

সহিহ বুখারিতে বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তির চমৎকার ঘটনা বর্ণিত আছে, যা ঋণের আমানতদারিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এক ব্যক্তি ১০০০ দিনার ঋণ নিয়েছিল এবং আল্লাহকে সাক্ষী ও জিম্মাদার বানিয়েছিল। পরিশোধের নির্দিষ্ট দিনে সে নদীর ঘাটে গিয়ে দেখল কোনো নৌকা নেই। সে তখন একটি কাঠের টুকরো নিয়ে তা খোদাই করল এবং তার ভেতর ১০০০ দিনার ও একটি চিঠি ভরে মুখ বন্ধ করে দিল। এরপর সে আল্লাহর ওপর ভরসা করে কাঠটি সমুদ্রে ভাসিয়ে দিল। অলৌকিকভাবে আল্লাহ সেই কাঠ ঋণদাতার কাছে পৌঁছে দেন। ঋণগ্রহীতা পরে আবার টাকা নিয়ে হাজির হলে ঋণদাতা জানান, “তোমার পাঠানো কাঠ ও টাকা আমি পেয়েছি, আল্লাহ তোমার পক্ষ থেকে তা আদায় করে দিয়েছেন।”

ঋণ আদান-প্রদানের ইসলামি শিষ্টাচার

  • লিখিত রাখা: ঋণের লেনদেন ভবিষ্যতে যাতে কোনো বিবাদ না ঘটায়, সেজন্য আল্লাহ তায়ালা তা লিখে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন (সূরা বাকারা: ২৮২)।

  • উত্তমভাবে পরিশোধ: ঋণ পরিশোধের সময় মূল টাকার চেয়ে সামান্য বাড়িয়ে দেওয়া বা উত্তম ব্যবহার করা সুন্নাত (যদি তা আগে থেকে শর্ত করা না থাকে)। রাসুল (সা.) এক ব্যক্তির কাছ থেকে উট ধার নিয়েছিলেন এবং পরে তার চেয়ে উত্তম উট ফেরত দিয়েছিলেন।

  • নিয়ত ঠিক রাখা: হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি পরিশোধের নিয়তে ঋণ নেয়, আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। আর যে আত্মসাতের নিয়তে নেয়, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করেন (সহিহ বুখারি)।

ঋণ মুক্তির দোয়া

ঋণ বা দেনার বোঝা থেকে মুক্তি পেতে রাসুলুল্লাহ (সা.) এই দোয়াটি বেশি বেশি পাঠ করতে শিখিয়েছেন:

আরবি: اللَّهُمَّ اكْفِنِي بِحَلَالِكَ عَنْ حَرَامِكَ، وَأَغْنِنِي بِفَضْلِكَ عَمَّنْ سِوَاكَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাকফিনি বিহালালিকা আন হারামিকা, ওয়া আগনিনি বিফাদলিকা আম্মান সিওয়াক।
অর্থ: “হে আল্লাহ! হারামের পরিবর্তে তোমার হালাল রিজিক আমার জন্য যথেষ্ট করে দাও এবং তোমার অনুগ্রহ দ্বারা আমাকে অন্য সবার থেকে অমুখাপেক্ষী করে দাও।” (তিরমিজি ৩৫৬৩)

ঋণ নেওয়া দোষের নয়, কিন্তু পরিশোধ না করা বা অবহেলা করা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জায়গাতেই লাঞ্ছনার কারণ। তাই আমাদের উচিত সাধ্যমতো ঋণ এড়িয়ে চলা এবং ঋণ থাকলে তা দ্রুত পরিশোধের চেষ্টা করা।

Sources