
২০২৪ সালে গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে হু-হু করে। অনেক গ্রাহক নানা অজুহাতে ঋণ পরিশোধে অনীহা দেখাচ্ছেন। ঋণ পুনঃতফসিল, আদালতের স্টে অর্ডার বা ব্যবসায়িক ক্ষতির অজুহাতে আদায় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় নগণ্য। জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অগ্রণী, জনতা, সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে আদায় হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর নজরদারি বাড়িয়েছে, তবে আদায় এখনো সীমিত।
নথিপত্র অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী, জনতা, সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে বকেয়া অর্থের পরিমাণ ৩১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা। আর ঋণ আদায়ের লক্ষ্য ছিল ২ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। সেখান থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ২১৯ কোটি। আদায়ের হার লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, খেলাপি ও অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বার্ষিক এমওইউ রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ঋণ আদায়ে সব সময় ব্যাংকগুলোকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। কিন্তু খেলাপিরা আদালতে যেতে বেশি আগ্রহ দেখায়; ঋণ পরিশোধে তাদের আগ্রহ নেই বললে চলে। সরকারি ব্যাংকের ঋণ নিয়ে অনেকে দানের অর্থের মতো খেয়ে ফেলেন।
পরিসংখ্যান বলছে, মার্চ মাস শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। জুন শেষে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকায় এবং আরও প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা অদৃশ্য খেলাপি রয়েছে। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ।
গত মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বা ৩৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ। একক ব্যাংক হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭০ হাজার ৮৪৫ কোটি বা ৭৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ, দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ২৯ হাজার ৭২০ কোটি বা ৪১ দশমিক ৩৫ শতাংশ, তৃতীয় অবস্থানের সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ১৯ হাজার ৯১ কোটি বা ২১ দশমিক ১১ শতাংশ, চতুর্থ অবস্থানের রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ১৭ হাজার ১২২ কোটি টাকা বা ৩৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৬৪৬ কোটি বা ৬৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। বিডিবিএল ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৯৮০ কোটি টাকা বা ৪৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আদায় জোরদারের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে খেলাপি ঋণের লক্ষ্যের বড় একটি অংশ আদায় হয়েছে। আমরা খেলাপি ঋণ আদায়ে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু খেলাপিরা একের পর এক অজুহাত দেখাচ্ছে।’
গত মঙ্গলবার ২ শতাংশ জমা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই ঋণের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ১০ বছর। ঋণ পরিশোধ শুরু করার ক্ষেত্রে দুই বছরের বিরতি সুবিধা থাকবে। এই সুবিধা পেতে ডিসেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে আবেদন করতে হবে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, দেশের ভালো ব্যবসায়ীদের অনেকে ভুগছেন। তাঁদের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। কখন নির্বাচন হবে, এ জন্য অপেক্ষা করছেন। কেউ কেউ পালিয়েছেন, আবার কেউ জেলে আছেন। দেশের জিডিপি ও কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখতে পারেন, এমন ব্যবসায়ীদের জন্য এই সুবিধা প্রয়োজন ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ব্যাংকগুলোর অর্থঋণ আদালতের মামলায় আটকা অর্থ ১ লাখ ৭৮ হাজার কোটি আর অবলোপন করা ঋণ প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি আদালতের স্টে অর্ডারে আটকা রয়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। যার পরিমাণ ৩ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। এসব খেলাপি ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটে না দেখিয়ে গোপন করা থাকে। খেলাপি হয়ে পড়া ১ হাজার ২০০ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ঋণ বিশেষ বিবেচনায় নবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপি অবশ্যই আলাদা। ব্যাংক কোম্পানি আইনে তা নির্দিষ্টভাবে পৃথক করার বিধান রয়েছে। খেলাপির কাছ থেকে অর্থ আদায়ে কঠোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এই সংকটের মধ্যেও সরকারি ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য নতুন কৌশল গ্রহণ করছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দ্রুত নির্বাচন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
Comments