‘কংক্রিটে’ ঢাকা কক্সবাজার সৈকত, দেশি পর্যটকে সরগরম থাকলেও নেই বিদেশি!

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত হিসেবে খ্যাত কক্সবাজার দিন দিন কংক্রিটময় হয়ে উঠছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত এই সৈকত শহরে দেশি পর্যটকদের ভিড় বাড়লেও বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে। পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বিনোদনের অভাব, এবং টেকসই পর্যটনের উদ্যোগের ঘাটতি এর জন্য দায়ী।
প্রকৃতি হারাচ্ছে কক্সবাজার
কক্সবাজারের পর্যটনের মূল আকর্ষণ ছিল এর অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কিন্তু বর্তমানে সৈকতের চারপাশে গড়ে উঠছে বহুতল হোটেল, রেস্টুরেন্ট, এবং অপরিকল্পিত স্থাপনা। পরিবেশবাদীদের মতে, প্রকৃতি রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগের অভাব এবং ইকো-ট্যুরিজমের প্রতি উদাসীনতা কক্সবাজারের পর্যটনকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
‘সেভ দ্যা ন্যাচার অব বাংলাদেশ’ এর চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, “কক্সবাজারে পরিকল্পনাহীন হোটেল নির্মাণই এখন প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ প্রকৃতিনির্ভর ট্যুরিজমই দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সমাধান দিতে পারে। বিদেশি পর্যটকরা কংক্রিটের জঙ্গল দেখতে আসে না, তারা আসে প্রকৃতি ও সংস্কৃতির টানে।”
দেশি পর্যটকের ভিড়, বিদেশিরা কোথায়?
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, কক্সবাজারে নিবন্ধিত হোটেল, মোটেল, এবং রিসোর্টের সংখ্যা প্রায় ৬০০। কক্সবাজার হোটেল-গেস্ট হাউস মালিক সমিতির তথ্যমতে, শুধু কলাতলী এলাকার ৩ বর্গকিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে ৫৩৮টি হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, এবং কটেজ। পিক সিজনে এখানে দেশি পর্যটকের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ লাখ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা এতই কম যে, জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেল এ বিষয়ে কোনো তথ্যই দিতে পারেনি।
তারকা মানের হোটেল ‘দি কক্স টুডে’র জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আবু তালেব জানান, গত এক বছরে তাদের হোটেলে কোনো বিদেশি পর্যটক আসেননি। এই চিত্র কক্সবাজারের পর্যটনের জন্য উদ্বেগজনক।
বিনোদন ও ইকো-ট্যুরিজমের অভাব
পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকত ছাড়া আন্তর্জাতিক মানের কোনো বিনোদন সুবিধা নেই। মহেশখালী, সোনাদিয়া, ইনানী, বা হিমছড়ির মতো সম্ভাবনাময় স্থানগুলো থাকলেও সেগুলোর উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারি পর্যায়ে ইকো-ট্যুরিজমের নামে যে সামান্য উদ্যোগ রয়েছে, তা কার্যত নিষ্প্রাণ। স্থানীয় উদ্যোক্তারাও বড় বিনিয়োগে আগ্রহী নন।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, “আমরা শুধু হোটেল বানানো আর জমির দাম বাড়ানো নিয়েই ব্যস্ত। বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা, এবং আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রয়োজন। টেকসই পর্যটনের জন্য একটি সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান জরুরি।”
পর্যটকদের অভিযোগ
দেশি পর্যটকদের মধ্যেও কক্সবাজারের সৈকত ও সেবা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। ঢাকার বারিধারা থেকে আগত মোকাম্মেল হোসেন বলেন, “এখানে কিছুই পরিকল্পিত নয়। ভ্রাম্যমাণ দোকান, কীটকট, আর ছাতার সারি পর্যটকদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। আধুনিক চেঞ্জিং রুম বা গোসলের ব্যবস্থা নেই। হোটেল ও যানবাহনের ভাড়াও অত্যধিক। এই টাকায় বিদেশ ভ্রমণ সম্ভব।”
পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী জামশেদ হোসাইন জানান, রাতে সৈকতের কিছু এলাকা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। হোটেল-মোটেল জোনের নির্জন স্থানগুলোও নিরাপদ নয়। তিনি আরও বলেন, “হোটেলগুলো এত কাছাকাছি গড়ে উঠেছে যে মনে হয় ঢাকার কোনো আবাসিক এলাকায় আছি।”
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সংকট
সৈকতের বিভিন্ন অংশে প্লাস্টিকের বোতল, খাবারের প্যাকেট, এবং পলিথিনের স্তূপ চোখে পড়ে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পর্যাপ্ত ডাস্টবিনের অভাবে পর্যটকরা যেখানে-সেখানে বর্জ্য ফেলছেন। হোটেল ও রেস্টুরেন্ট থেকে উৎপন্ন বর্জ্যও সরাসরি সমুদ্রে পড়ছে, যা পরিবেশের জন্য হুমকি।
কক্সবাজার হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন, “হোটেল-মোটেল জোনের রাস্তার অবস্থা শোচনীয়। দীর্ঘদিন ধরে চলমান কাজের কারণে বর্ষায় পর্যটকদের ভোগান্তি বাড়ে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও উন্নত সেবা নিশ্চিত করা গেলে এই শিল্প সমৃদ্ধ হবে।”
সেন্ট মার্টিনেও একই দশা
কক্সবাজারের মতোই সেন্ট মার্টিনেও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে ২০০টির বেশি হোটেল-রিসোর্ট, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। পরিবেশ রক্ষায় সরকার প্রতিদিন মাত্র ২,০০০ পর্যটককে দ্বীপে ভ্রমণের অনুমতি দিলেও এটি যথেষ্ট নয়।
টেকসই পর্যটনের পথে চ্যালেঞ্জ
কক্সবাজার সিটি কলেজের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মইনুল হাসান পলাশ বলেন, “পর্যটন একটি সেবা। সেবার মান উন্নত না হলে শুধু অবকাঠামো গড়ে টেকসই পর্যটন সম্ভব নয়। ভুটান ও মালদ্বীপের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে গুণমান, বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা, এবং পরিবেশ সচেতন নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।”
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপ-পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ তানভীর হাসান রেজাউল জানান, নতুন মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে, যা আগামী জুনের মধ্যে শেষ হবে। তবে তিনি মনে করেন, অপরিকল্পিত স্থাপনা নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, এবং পৌরসভার সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশি পর্যটক ছাড়া পর্যটন খাত অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে না। প্রকৃতি ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে টেকসই পর্যটন গড়ে তুলতে না পারলে কক্সবাজার কেবল দেশি পর্যটকের ভিড়ে সীমাবদ্ধ থাকবে। নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা, এবং আন্তর্জাতিক মানের সেবা নিশ্চিত করা গেলে কক্সবাজার বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে নিতে পারে।
Comments