কাঁথা সেলাই এক প্রকার শিল্প। এক সময় কাঁথা, বিশেষ করে নকশি কাঁথা, প্রায় ঘরে ঘরে তৈরি করা হতো। গ্রামে খাওয়ার পর ক্লান্ত দুপুরে ঘরের সব কাজ সেরে নারীরা ঘরের মেঝে, বারান্দা বা গাছের ছায়ায় মাদুর পেতে বসত কাঁথা নিয়ে। এক একটি নকশী কাঁথা তৈরি করতে মাসখানেক সময় লাগতো তখন। সুঁইয়ের প্রতিটি ফোঁড়ে তৈরি হতো এক একটি না বলা কথা। কতশত ইতিহাস আর গল্প এই কাঁথা সেলাই কিংবা নকশী কাঁথা নিয়ে।
তবে কালের বিবর্তনে নকশী কাঁথা এখন অনেকটা বিলীনের পথে হলেও নীলফামারীর সৈয়দপুরে চুক্তিতে কাঁথা সেলাই করে বাড়তি আয় করেন অনেক নারী। বিশেষ করে শীতের শুরুর দিকে বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় দেখা মিলে কাঁথা সেলাইয়ের। কেউ গাছের নিচে কিংবা বারান্দায় বা সুবিধাজনক স্থানে বসে এসব কাঁথা সেলাই করে থাকেন।
সরেজমিনে রবিবার (১৯ অক্টোবর) এমনি একটি দৃশ্য দেখা গেল সৈয়দপুরের গোলাহাট এলাকায়। গৃহবধূ সকিনা নাটকি ও সিতারা বেগমসহ অন্যান্যরা চুক্তিতে অন্যের কাঁথা সেলাই করছেন আপন মনে।
সকিনা নাটকি বলেন, সাংসারিক কাজের পাশাপাশি এ কাঁথা তৈরি করি। মূলত শীত আগমনের আগে এরূপ কাঁথা সেলাই করতে আসেন অনেকে। সাধারণত এরূপ কাঁথা সেলাই করতে ৮/১০ দিন লেগে যায়। তবে আকার ভেদে কাঁথা তৈরিতে সময় কমবেশি হয়ে থাকে। একটি নরমাল কাঁথা তৈরিতে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা চুক্তিতে কাজ করেন তাঁরা। কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নয়, অবসর সময়ে বাড়তি আয়ের জন্যই এই কাঁথা সেলাই বলে জানান তিনি।
একই এলাকার গৃহবধূ সিতারা বেগম, রওশনী ও চাঁদনী বেগম বলেন, পুরনো অথবা নতুন কাপড় দিয়ে মূলত এসব কাঁথা তৈরি করা হয়। প্রথমে নতুন-পুরনো কাপড়ের কয়েকটি স্তর এক সাথে করে বাউন্ড্রি সেলাই করা হয়। তারপর চলে আস্তে আস্তে সেলাইয়ের কাজ। যদি নকশী কাঁথা হয় তাহলে আগে বিভিন্ন নকশার ছক আঁকতে হয়। আর এ ছকের ওপর বিভিন্ন রঙের সুতা দিয়ে নকশা ফুটিয়ে সুজনি ফোঁড়, কাঁথা ফোঁড় ও বকুল ঝাড় কাঁথা তৈরি করা হয়। যদিও এখন কেউ নকশী কাঁথা বানাচ্ছে না বলে জানান তিনি।
অপর গৃহবধূ নুরজাহান ও শবনম পারভীন বলেন, কাঁথা শুধু বাড়ির জন্যই তৈরি করি তা নয়। আমরা অনেকে মজুরি হিসেবেও কাঁথা সেলাই করে থাকি। ৪ বাই ৬ ফুট আকারের কাঁথা ৫০০ থেকে শুরু করে আকার ভেদে ৮০০, ৯০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি হয়ে থাকে। অবসর সময়ে এক একটি কাঁথা তৈরিতে এক সপ্তাহ থেকে দশদিন সময় লেগে যায়। আর এ থেকে যে বাড়তি আয় হয় তা ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংসারিক কাজে ব্যয় করা হয়।
সৈয়দপুর মহিলা মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক শিউলী বেগম বলেন, এক সময় গ্রামীণ ঐতিহ্য ছিল নকশি কাঁথা। গ্রামের মেয়েরা তাদের মনের মাধুরী মিশিয়ে সেলাই করতেন। যেখানে প্রতিটি ফোঁড়ে গেঁথে থাকত প্রিয়জনদের বলা না বলা কথা। সেইসব নকশী কাঁথা এখন অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে। নকশী কাঁথা না হলেও সাধারণ কাঁথা এখনো শীতের আগে শহর-গ্রামের নারীরা তৈরি করে আসছেন। যারা এসব শিল্পের সঙ্গে জড়িত তাদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হলে পুনরায় এ শিল্পকর্মকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সেই সঙ্গে হাতেকলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে সৈয়দপুর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহীদ ইশরাক বলেন, গ্রামীণ ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ নকশী কাঁথা। এটি এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। নকশী কাঁথাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত নারীদের সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সহযোগিতা করা যেতে পারে।
Comments