Image description

এক সময় দেশের অন্যতম লাভজনক অর্থকরী ফসল ছিল পান। কিন্তু হঠাৎ করে রপ্তানি কমে যাওয়ায় পানের দাম পানির দরে নেমে এসেছে। আর বাজার ধসের কারণে বর্তমানে সেই পানই চাষিদের জন্য পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে। ব্যয়বহুল এই চাষে ঋণের টাকায় ভর করে চাষ করা পান এখন বিক্রি না হওয়ায় নদীতে ফেলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন হতাশ কৃষকরা।

বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার পানচাষি আব্দুল হান্নান অভিযোগ করে বলেন, “২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতি কেজি পানের রপ্তানি মূল্য ১ ডলার থেকে হঠাৎ করে ৫ ডলার নির্ধারণ করায় বিদেশি ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বাজার ভেঙে পড়েছে, হাজারো চাষি আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত।”

বরিশাল জেলা থেকে বিপুল পরিমাণ পান রপ্তানি হতো মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। কিন্তু রপ্তানিতে বাধা ও ব্যাকটেরিয়া শনাক্তের কারণে এখন সেই বাজার কার্যত বন্ধ। এতে অভ্যন্তরীণ বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ সৃষ্টি হয়েছে, ফলে দাম কমে গেছে অস্বাভাবিকভাবে।

পোর্ট রোড বাজারের ব্যবসায়ী মো. সোহেল বলেন, “গত ১৩ বছরে এমন পরিস্থিতি দেখিনি। গত বছর যে পান ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এ বছর সেই পান ৫০ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে না। খরচ পুষিয়ে ওঠানোই এখন দায়।”

চরমোনাই এলাকার পান ব্যবসায়ী সুজন নাথ বলেন, “২৫ বছর ধরে এই পানের ব্যবসার সঙ্গে আছি। এমন বিপর্যয় আগে হয়নি। দেড়শ টাকার পানের চল্লি এখন ৩০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে না।”

বরিশাল জেলা পান চাষি সমিতির সভাপতি মো. মামুন মানবকণ্ঠকে বলেন, “এক বিড়া পানে ৫০ টাকা খরচ হয়, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়। কখনো কখনো ৫ টাকায়ও বিক্রি করতে হয়। আবার অনেক সময় বাজার না থাকায় পান ফেলে দিতেও বাধ্য হই।”

সমিতির সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী মানবকণ্ঠকে বলেন, “প্রতি বিড়া পানে গড়ে ৩০ টাকা ক্ষতি হচ্ছে। পানের দাম না পেলে চাষিরা টিকতে পারবে না। আমরা চাই আগের মতো রপ্তানি শুরু হোক।”

বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১০ উপজেলায় ২ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট উৎপাদন হয়েছে ২১ হাজার ৪০৯ মেট্রিক টন। এই খাতে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার মানুষ।

বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোসাম্মাৎ মরিয়ম মানবকণ্ঠকে বলেন, “গত বছরের তুলনায় এ বছর উৎপাদন বেড়েছে। ফলে দাম কিছুটা কমেছে। পাশাপাশি আগের মতো রপ্তানি হচ্ছে না কারণ পানে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত হওয়ায় রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।”

পানের রপ্তানি বৃদ্ধি ও সব ধরনের বাধা অপসারণ। বিপন্ন চাষিদের ঋণের কিস্তি আদায় সাময়িক বন্ধ। গরিব চাষিদের সরকারি ত্রাণ ও রেশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি। উৎপাদক চাষিদের প্রণোদনা প্রদান। খৈল, সার, কীটনাশকসহ উপকরণের দাম কমানো। পান গবেষণা কেন্দ্র ও সংরক্ষণাগার স্থাপন। আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ প্রদান। জমিতে অতিরিক্ত খাজনা আদায় বন্ধ। পান চাষিদের জন্য বীমা চালু। জাতীয় পান বোর্ড গঠন। পানের দাম বাড়লে ভারত থেকে পান আমদানি বন্ধ।

পান শুধু একটি কৃষিপণ্য নয়, গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বড় অংশ। এই খাত ভেঙে পড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হবে লাখো মানুষের জীবিকা। কৃষকরা আশাবাদী, সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিলে পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে পারে পানের বাজার।

চাষিদের দাবি—রপ্তানি পুনরায় চালু, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও প্রণোদনা ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। সরকার যদি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে চাষিরা পান চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবেন—যা জাতীয় অর্থনীতিতেও ফেলবে নেতিবাচক প্রভাব।