চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে, সাগর ও মেঘনার সংযোগস্থলে গড়ে ওঠা দীর্ঘাপাড় ইউনিয়নের আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলো ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখে পড়েছে। এখানকার তিনটি সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের মধ্যে "কমরেড মুজফফর আহমদ আশ্রয়ণ প্রকল্প" অন্যতম। দীর্ঘ কয়েক বছর পার হলেও এখানকার ৪৭০টি পরিবারের মধ্যে প্রায় ৩৫০টি ঘরই জনশূন্য। বাকি পরিবারগুলোও বিদ্যুৎ, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, নিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও কবরস্থানের মতো মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে।
ঘর আছে, জীবন নেই: অবকাঠামো ও সেবার বেহাল দশা
নদীভাঙনের শিকার অসহায় মানুষের জন্য গড়ে তোলা এই আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলোর ঘরগুলোতে দেখা দিয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। অধিকাংশ ঘরে ফাটল ধরেছে, বৃষ্টির পানি চুঁইয়ে পড়ে, ল্যাট্রিনগুলো অচল, দরজা ভাঙা এবং পরিবেশ স্যাঁতসেঁতে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় রাত নামে ভয়াবহ অন্ধকারে, যা স্থানীয়দের মধ্যে সাপ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর আক্রমণের আতঙ্ক তৈরি করেছে। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে।
পানির জন্য ব্যবহৃত হাতে গোনা কয়েকটি টিউবওয়েলের অধিকাংশই অকেজো। ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষা মৌসুমে পুরো এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়, দুর্গন্ধ ছড়ায় এবং মশার উপদ্রব বেড়ে যায়।
রাত মানেই টিকে থাকার লড়াই
বিদ্যুৎ না থাকায় সৌরবাতি বা কেরোসিনই এখানকার মানুষের একমাত্র ভরসা। প্রকল্পে দুটি বিদ্যুতের খুঁটি বসানো হলেও অধিকাংশ ঘরে সংযোগ নেই। রাতে শিশুদের কান্না, চারপাশের নিস্তব্ধতা এবং অজানা আতঙ্কের মধ্যেই এখানকার বাসিন্দারা প্রতিটি রাত টিকে থাকার লড়াই করে।
সেবা বঞ্চিত, মৌলিক অধিকারের অভাব
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার কিংবা হাসপাতাল—সবই আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে। বর্ষার দিনে শিশুদের কাদাপানিতে হেঁটে স্কুলে যেতে হয়, যা তাদের প্রায়শই অসুস্থ করে তোলে। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের ১২-১৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্রে নিতে হয়, যা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।
মৃত্যুর পরও নেই মর্যাদা: কবরস্থানের তীব্র সংকট
প্রায় ৪৭০টি পরিবার বাস করা সত্ত্বেও আশ্রয়ণ প্রকল্পটিতে কোনো কবরস্থান নেই। ফলে কেউ মারা গেলে মরদেহ কাঁধে করে দূরের গ্রামে নিয়ে যেতে হয় দাফন করার জন্য। মর্যাদাহীন এই দৃশ্য স্থানীয়দের হৃদয়ে গভীর কষ্টের সৃষ্টি করে।
দখলদারিত্বের থাবা: প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণ
আশ্রয়ণ প্রকল্পের কিছু ঘর প্রভাবশালী মহলের দখলে রয়েছে, যারা সেখানে বসবাস করেন না। প্রকল্পের সংলগ্ন জলাশয়গুলোও প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, যার ফলে সাধারণ মানুষ মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রকল্পবাসীদের ১৬ দফা দাবি: মানবিক সংকট নিরসনের আহ্বান
স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা এসডিআই ও কোস্ট ফাউন্ডেশন পরিচালিত "ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স (CCR)" প্রকল্পের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আশ্রয়ণ প্রকল্পবাসীরা তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও দুর্ভোগের অবসানের লক্ষ্যে ১৬ দফা দাবি উত্থাপন করেছেন। এই দাবিগুলো হলো:
১. প্রতিটি ব্যারাকে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন এবং সাপ্তাহিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা।
২. উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা চালু করা ও স্থানীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া।
৩. কবরস্থান নির্ধারণ করে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা।
৪. প্রকল্প সংলগ্ন জলাশয়গুলো দখলমুক্ত করে মাছ চাষের সুযোগ সৃষ্টি করা।
৫. একটি টিনশেড মার্কেট নির্মাণ করা।
৬. পরিবারের সদস্যসংখ্যা অনুযায়ী ঘর পুনর্বিন্যাস করা।
৭. ভোটার এলাকা স্থানান্তর এবং সরকারি সুবিধা নিশ্চিত করা।
৮. ন্যায্যমূল্যের চাল বিতরণে ডিলার নিয়োগ দেওয়া।
৯. ৫ কড়া জমির দলিল প্রদান করা।
১০. নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।
১১. প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ ও প্রয়োজনীয় খুঁটি স্থাপন করা।
১২. পুরনো ঘর ও ল্যাট্রিন সংস্কার করা।
১৩. দরজা ও কমোড নবায়ন করা।
১৪. নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদান করা।
১৫. চলাচলের একমাত্র কাঁচা রাস্তাটি পাকাকরণ করা।
১৬. টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা।
"আশ্রয় মানেই মাথার ছাদ নয়, তা বাঁচার অধিকার"
আশ্রয়ণ প্রকল্পবাসীরা প্রত্যাশা করেন যে, এই ভয়াবহ মানবিক সংকট স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং নীতিনির্ধারকদের নজরে আসবে। তারা শুধু উন্নয়ন নয়, বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।
Comments