 
                   চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দিদের খাওয়ার পানিতে ‘কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার’ উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রসের সহযোগিতায় এ পানি পরীক্ষা করেছিল কারা কর্তৃপক্ষ। পরীক্ষার প্রতিবেদনে দেখা যায়, পানিতে ‘কলোনি ফর্মিং ইউনিট’ এক হাজার ৮০০ পর্যন্ত রয়েছে। যার সহনীয় মাত্রা শূন্য। এই পানি বন্দিদের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। মূলত কারাগারের স্যুয়ারেজের সংযোগের সঙ্গে পানির সংযোগে একাকার হয়ে এ ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানালেন সংশ্লিষ্টরা।
কারা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দির সংখ্যা ছয় হাজার। তারা এই পানি পানের পাশাপাশি ব্যবহার করছেন প্রতিদিন। পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর বন্দিদের জন্য একজন স্যানিটেশন ইন্সপেক্টর নিয়োগ দিয়েছেন জেলা সিভিল সার্জন। ওই কর্মকর্তা পানিসহ বন্দিদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে এসব ক্ষতিকারক দিকগুলো নিয়ে তদারকি করবেন বলে জানা গেছে।
চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, মানবদেহের অন্ত্রে বাসকরা কিছু ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়াকে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া বলা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে প্রধানতম হলো E. coli|। একে জনস্বাস্থ্যের ভাষায় ইন্ডিকেটর ব্যাকটেরিয়াও বলা হয়। স্তন্যপায়ী প্রাণীর অন্ত্র এই ব্যাকটেরিয়ার উৎস। যদিও প্রকৃতিতে বা মাটিতে এ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি খুব স্বাভাবিক, কিন্তু পানিতে এ রকম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ঘটলে বুঝতে হবে সেই পানিতে প্রাণিজ বর্জ্যের মিশ্রণ ঘটেছে।
কলিফর্মের উপস্থিতি বিভিন্ন আন্ত্রিক ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা তৈরি করে। মিশ্রিত পানি পানের মাধ্যমে ডায়রিয়া, আমাশয়, রক্ত আমাশয়, কলেরা, টাইফয়েড ছাড়াও ভাইরাল হেপাটাইটিস (জন্ডিস) রোগের সূচনা করে। পানিতে এর উপস্থিতি পাওয়া গেলে ধরে নিতে হবে যে, সরবরাহ ব্যবস্থায় ত্রুটি আছে। সেক্ষেত্রে পানি ১৫ মিনিট ফুটিয়ে ঠান্ডা করে পান করতে হবে।
চট্টগ্রাম কারাগার সূত্র জানিয়েছে, কারাগারে থাকা ১১টি পানির পাম্পের মধ্যে ১০টি সাবমার্সিবল পাম্পের পানির নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রসের একটি টিমের সহায়তায় ঢাকার ল্যাবে করানো এ পরীক্ষার নয়টির প্রতিবেদন সম্প্রতি হাতে পেয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। তারা সেগুলো জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে হস্তান্তর করেছে। প্রতিবেদনে পাঁচটি সাবমার্সিবল পাম্পের পানিতে মিলেছে জীবাণু। এর মধ্যে তিনটির পানিতে মিলেছে ‘কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া’। পাম্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- কারাগারের পদ্মা ওয়ার্ডে একটি, যমুনা ওয়ার্ডে একটি এবং প্রশাসনিক ভবনের সামনের একটি। প্রশাসনিক ভবনের ওই পাম্পের পানি কারাগারের আবাসিকেও ব্যবহার করা হয়। বাকি দুটিতে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি মিলেছে ‘হার্ডনেস’ বা খরতা। এর মধ্যে হালদা ওয়ার্ডে হার্ডনেস মিলেছে ৪৮০। যা থাকার কথা ৩০০ এর মধ্যে। কারা হাসপাতালের পাম্পে হার্ডনেস মিলেছে ৩৫০। যা থাকার কথা ৩০০ এর মধ্যে। এর মাত্রা বেশি থাকায় স্বাস্থ্যের জন ক্ষতিকর।
কারা কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, কারাগারের পয়োনিষ্কাশন (স্যুয়ারেজ) এবং পানির সংযোগ একাকার হয়ে এ ব্যাকটেরিয়া পানিতে মিশেছে। এ পানির ব্যবহার হচ্ছে বন্দিদের রান্না, গোসল, পয়োনিষ্কাশনসহ সব কাজে। এমনকি পানও করছেন বন্দিরা। বিষয়টি জানার পরও পানি সংকটের অজুহাতে পান ও ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে কারা কর্তৃপক্ষ।
তবে মানবাধিকার সংগঠকদের দাবি, বন্দিদের বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার অধিকার আছে। এক্ষেত্রে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। এ পানি পানে যারা অসুস্থ হয়েছেন এবং হবেন তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সৈয়দ শাহ শরীফ বলেন, ‘কারাগারে বন্দিদের জন্য ১১টি পানির পাম্প রয়েছে। এর মধ্যে ১০টির পানির নমুনা পরীক্ষা করেছে ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রস। পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। তবে প্রতিবেদনে, এসব পানি খাওয়া যাবে না এ ধরনের কোনও তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। আর্সেনিকসহ কিছু ছোটখাটো সমস্যার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সব সময় কারাগার ভিজিট করেন। আমরা তাদের কাছে এসব প্রতিবেদন দিয়েছি। ব্যাকটেরিয়া দূর করার উপায় খোঁজা হচ্ছে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেছেন, সমাধান করবেন। তখন সমস্যা থাকবে না। বছরের পর বছর এ পানি বন্দিরা পানসহ ব্যবহার করছেন। এখনও ব্যবহার অব্যাহত আছে।’
একই বিষয়ে জানতে চাইলে কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ইকবাল হোসেন বলেন, ‘পানির নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন আমরা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে হস্তান্তর করেছি। এসব পানি পান বা ব্যবহার বন্ধ করার বিষয়ে এখনও কোনও পরামর্শ দেননি স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা পরামর্শ দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা কারাগারের ১০টি পাম্পের পানি পরীক্ষা করেছে। তার মধ্যে নয়টি পাম্পের প্রতিবেদন দিয়েছে সংস্থাটি। কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ওই প্রতিবেদনে নয়টি পাম্পের মধ্যে পাঁচটির পানিতে সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটিতে মিলেছে ‘কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া’। বাকি দুটিতে মিলেছে হার্ডনেস বৃদ্ধির বিষয়টি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব পাম্পের পানিতে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি মিলেছে সেগুলোর পানি দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে জন্ডিস, হেপাটাইটিস-এ, ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ওই পাঁচটি পাম্পের পানি পান ও ব্যবহার থেকে বিরত থাকার জন্য আমরা কারা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। পাশাপাশি পাম্পগুলো সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য চট্টগ্রাম জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরকেও চিঠি দিয়েছি। ওয়াসার পানির লাইন ও টয়লেটের স্যুয়ারেজ লাইন কোথাও ছিদ্র হয়ে গেছে। যার কারণে ওয়াসার লাইনে সরাসরি যুক্ত হয়ে যাওয়ায় খাওয়া ও ব্যবহারের পানিতে মল মিশে একাকার হয়ে গেছে। এ কারণে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি মিলেছে।’
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্যের পরিচালক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘কারাগারের কয়েকটি পাম্পের পানিতে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি জানার পর পানি দূষণের কারণ ও উৎপত্তিস্থল উদঘাটনের কাজ শুরু করা হয়েছে। এ পানি পানে জন্ডিসসহ নানা ধরনের পানিবাহিত রোগ হতে পারে। যেহেতু কারাগারের ভেতরের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি জেলা সিভিল সার্জন এবং স্যানিটেশনের বিষয় জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর তদারকের দায়িত্বে রয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর বিষয়টি জানার পর বিষয়টি দ্রুত সমাধান করার জন্য তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে কারাগারে একজন স্যানিটেশন ইন্সপেক্টর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি বন্দিদের খাবার পানিসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখবেন।’
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ চন্দ্র দাস বলেন, ‘কারাগারের পানির পাম্পে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। পানির নমুনা পরীক্ষার বিষয়েও আমি জানি না।’
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) আইন উপদেষ্টা ও মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন-বিএইচআরএফর মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘স্বাস্থ্যসম্মত বিশুদ্ধ পানি পাওয়া প্রত্যেক বন্দির অধিকার। কারাগারের পানিতে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার মতো জীবাণু পাওয়ার পরও এই পানি সরবাহ অব্যাহত রেখে কারা কর্তৃপক্ষ বন্দিদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। দ্রুত এই পানি বন্ধ করে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ করা হোক। পাশাপাশি কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়াযুক্ত পানি পানে যারা অসুস্থ হয়েছেন এবং সামনে হবেন তাদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে কারা কর্তৃপক্ষকে।’
 
                



 
               
Comments