বদলগাছীতে ৪ শিক্ষকের মাদ্রাসায় নেই একজনও শিক্ষার্থী, তালাবদ্ধ শ্রেণিকক্ষ
নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার দাউদপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার ইবতেদায়ি শাখায় (প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি) কাগজে-কলমে ১০৪ জন শিক্ষার্থী থাকলেও বাস্তবে একজনও নেই। অথচ শিক্ষার্থীশূন্য এই শাখায় কর্মরত রয়েছেন চারজন শিক্ষক। তারা নিয়মিত হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করছেন এবং মাস শেষে সরকারি বেতন-ভাতা তুলছেন।
মাদ্রাসায় প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে এক অদ্ভুত নীরবতা। ইবতেদায়ি শাখার পুরোনো টিনশেডের শ্রেণিকক্ষগুলো তালাবদ্ধ। জানালা দিয়ে উঁকি দিলে দেখা যায়, ভেতরে ধুলোমাখা বেঞ্চ-টেবিল, একপাশে স্তূপ করে রাখা ভাঙাচোরা আসবাব এবং মাকড়সার জাল। দেখে বোঝার উপায় নেই এটি একটি সচল এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পাশের নতুন ভবনে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির কার্যক্রম চললেও প্রাথমিক স্তরের এই ভবনটি যেন পরিত্যক্ত।
মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাদ্রাসায় কয়েকজন শিক্ষক উপস্থিত থাকলেও ইবতেদায়ি শাখার কোনো শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চলছে না। শিক্ষকরা অফিস কক্ষে বসে মোবাইল ফোনে সময় কাটাচ্ছেন। হাজিরা খাতায় ১০৪ জন শিক্ষার্থী দেখানো হলেও বাস্তবে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, হাজিরা খাতায় যাদের নাম রয়েছে তারা আসলে অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। কাগজ-কলমে সাজিদ ও আরিফ নামের দুই শিক্ষার্থীর নাম থাকলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারা দাউদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। আজমাইন নামের আরেক শিক্ষার্থী জানায়, সে বদলগাছী সদরের একটি মাদ্রাসায় নিয়মিত পড়াশোনা করছে। অর্থাৎ ভুয়া শিক্ষার্থী দেখিয়ে বছরের পর বছর সরকারি সুবিধা নেওয়া হচ্ছে।
এলাকাবাসী ও অভিভাবকদের মধ্যে এ নিয়ে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। স্থানীয় বাসিন্দা আলতাব ও সোহেল হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থী ছাড়াই শিক্ষক বহাল রাখা এবং বেতন তোলা বড় ধরনের দুর্নীতি। এতে একদিকে যেমন শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে।’ স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনিক তদারকির অভাবেই এমন অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে চলছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দাউদপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার সেকেন্দার আলী শিক্ষার্থী না থাকার সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘কিছু শিক্ষার্থী আছে, তবে উপবৃত্তি না পাওয়ায় তারা নিয়মিত আসে না। আগামী বছর থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে।’ এ সময় তিনি সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।
ইবতেদায়ি শাখার চার শিক্ষক- ইবতেদায়ি প্রধান তহুরা খাতুন, মৌলভী রেজাউল করিম, সাধারণ শিক্ষক শরিফুল ইসলাম ও ক্বারি সুফিউল্লাহ একই সুরে কথা বলেন। তাদের দাবি, উপবৃত্তি না থাকায় শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসামুখী হচ্ছে না। তবে তারা নিয়মিত মাদ্রাসায় আসছেন এবং আগামী বছরের জন্য শিক্ষার্থী সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি জুয়েল সরদার বলেন, ‘আমি মাত্র তিন মাস আগে দায়িত্ব নিয়েছি। শিক্ষার্থী শূন্যতার বিষয়টি সত্য। আমি শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে নির্দেশ দিয়েছি।’
এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিউল আলম বলেন, ‘আমি সরেজমিনে গিয়ে ঘটনার সত্যতা পেয়েছি। তাদের কাছে লিখিত জবাব চাওয়া হয়েছে। যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে, তাই বোর্ডকে বিষয়টি অবগত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইসরাত জাহান ছনি বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর আমি মাদ্রাসাটি পরিদর্শন করেছি এবং শিক্ষার্থী না থাকার কারণ জানতে চেয়েছি। আমরা মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডকে এ বিষয়ে অবগত করব।’
স্থানীয়দের প্রশ্ন, কোনো শিক্ষার্থী না থাকলেও কীভাবে বছরের পর বছর চারজন শিক্ষক বহাল থাকেন? কার তদারকিতে চলছে এই ‘কাগুজে’ শিক্ষা কার্যক্রম? সরকারি অর্থের এই অপচয়ের দায় কে নেবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সচেতন মহল।




Comments