Image description

বগুড়ার আদমদীঘিতে বিলুপ্ত পাট ক্রয়কেন্দ্রের কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকাশ্যে একটি সিন্ডিকেট চক্র এই লুটপাট চালাচ্ছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্থানীয় বিএনপি নেতাদের ছত্রছায়ায় একটি চক্র শেয়ারের মাধ্যমে জমিটির আইনি জটিলতা নিরসনের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। এর মাধ্যমে নামমাত্র মূল্যের সম্পত্তি মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে কোটি টাকায় হাতবদল করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। এ নিয়ে এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি এই সম্পত্তি রক্ষায় প্রশাসনের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সচেতন এলাকাবাসী।

জানা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে তৎকালীন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিক দেশের ১৭৫টি অংগন ও ১৪টি প্রেস হাউজের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি ‘বপাম/নীতি-২/লীজ-৮/৯৭/৯’ স্মারক মূলে সান্তাহার পাট ক্রয়কেন্দ্রটি মন্ত্রী তার ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’ হিসেবে পরিচিত বগুড়ার জাহানারা রশিদের কাছে মাত্র ২৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৭৩ টাকায় বিক্রি করে দেন। বিক্রয় দলিলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপ-সচিব শাহাদাত হোসেন মজুমদারের স্বাক্ষর থাকলেও সেখানে তার পরিচিতি নম্বর উল্লেখ ছিল না। ফলে এই হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ওঠে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি সম্পত্তি বিক্রির নিয়ম অনুযায়ী বহুল প্রচারিত জাতীয় ও ইংরেজি দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি। নামসর্বস্ব একটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কৌশলে প্রচার এড়িয়ে পানির দরে সম্পত্তিটি হস্তান্তর করা হয়।

আদমদীঘি ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার দড়িয়াপুর মৌজার ২.৩৮ একর জমির ওপর সান্তাহার পাট ক্রয়কেন্দ্রটি দেশ স্বাধীনের আগে স্থাপন করেছিলেন বগুড়ার সুরুজমল আগরওয়ালা। ১৯৮৫ সালে সরকার জুট ট্রেডিং করপোরেশনসহ ৪টি সংস্থাকে একীভূত করে বাংলাদেশ জুট করপোরেশন (বিজেসি) গঠন করলে কেন্দ্রটি এর আওতায় চলে যায়। ১৯৯৩ সালে বিজেসি বিলুপ্ত ঘোষণার পর কেন্দ্রটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। একসময় এখানে প্রায় ৬ হাজার ৯৫৪ বর্গফুটের ৩টি টিনের গুদাম, ১ হাজার ২০০ ফুটের বারান্দা, ১ হাজার ৫৫০ বর্গফুটের ইটের দালান, হস্তচালিত জুটপ্রেসার, লোহার সিন্দুকসহ কোটি টাকার আসবাবপত্র ও শতাধিক মূল্যবান গাছ ছিল। কিন্তু দিনের পর দিন স্থানীয় প্রভাবশালীদের লুটপাটের কারণে বর্তমানে সেখানে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পাট ক্রয়কেন্দ্রটি বিনা দরপত্রে বিক্রির জন্য মন্ত্রণালয় একটি ইচ্ছাপত্র জারি করে। মন্ত্রীর নির্দেশে উপ-সচিব শাহাদাত হোসেন মজুমদার স্বাক্ষরিত পত্রে মূল্যায়িত দরের ৫ শতাংশ বেশি দাম দেখিয়ে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়, যা ২০১২ সালের ২৯ মার্চ সম্পন্ন হয়। অথচ বর্তমানে এই সম্পত্তির বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা।

এই অনিয়মের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ১৩ মে তৎকালীন রাণীনগর উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন হেলাল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজ উদ্দিন ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইসমাইল হোসেন হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। হাইকোর্ট রুল জারিসহ বিক্রির কার্যক্রম ৬ মাসের জন্য স্থগিত করেন। সে সময় ক্রেতা পক্ষ মালামাল নিতে এলে এলাকাবাসী বাধা দেয় এবং মানববন্ধনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায়।

তবে গত ৫ আগস্টের পর প্রেক্ষাপট বদলে যায়। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে একটি চক্র রাণীনগর ও আদমদীঘি উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের যোগসাজশে পুরো জায়গাটি নতুন করে শেয়ার হোল্ডারদের নামে প্লট আকারে বিক্রির পায়তারা করছে। পরিত্যক্ত ইটের ভবন ভেঙে নতুন স্থাপনা নির্মাণের কাজও চলছে। ইতোমধ্যে আদমদীঘি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের মাধ্যমে ৮টি দলিল সম্পন্ন হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আদমদীঘি সাব-রেজিস্ট্রার মুদাচ্ছির হাসান গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন এবং বিষয়টি এড়িয়ে যান।

স্থানীয় বাসিন্দা মতিউর রহমান উজ্জ্বল বলেন, ‘জমির আইনি জটিলতা শেষ হয়েছে কি না তা আমাদের জানা নেই। অথচ শোনা যাচ্ছে জমি খণ্ড খণ্ড করে বিক্রি হচ্ছে। কেউ ১০ শতাংশ, কেউ ১৫ শতাংশ জমি কিনছেন। একটি চক্র সরকারকে ফাঁকি দিয়ে কোটি টাকার ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। এই সম্পদ বাঁচাতে দ্রুত সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’

পাট ক্রয়কেন্দ্রের ক্রেতা জাহানারা রশিদের মেয়ে নাজিয়া জাহান মুঠোফোনে জানান, ‘তৎকালীন সরকারের সব বিধি মেনেই আমরা জমি কিনেছিলাম। কিন্তু রাণীনগররে তৎকালীন এমপিসহ নেতাদের অনৈতিক চাহিদা পূরণ না করায় আমরা হয়রানির শিকার হই। ২০১২ সালেই জমির একাংশ বিক্রি করা হয়েছিল, কিন্তু রিটের কারণে দখল বুঝিয়ে দেওয়া যায়নি। সম্প্রতি আইনি জটিলতা নিষ্পত্তি হওয়ায় ক্রেতাদের জমি বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখনো কিছু মানুষের চাহিদা পূরণ না করায় আমাদের হয়রানি করা হচ্ছে।’

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে বগুড়া জেলা প্রশাসক তৌফিকুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।