Image description

সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় সংঘটিত আহাদ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। স্থানীয় একাধিক সূত্র ও নিহতের পরিবারের দাবি, সীমান্ত বাণিজ্য ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চলা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার এবং কোটি কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের বলি হয়েছেন আহাদ মিয়া। বিষয়টি বর্তমানে পুলিশি তদন্তাধীন থাকলেও অভিযোগের সব তীর এখন একটি সংঘবদ্ধ ‘বর্ডার সিন্ডিকেটে’র দিকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দোয়ারাবাজারের নরসিংপুর ইউনিয়নের নশিমপুর গরুর হাটের ইজারা ও ভারতীয় গরু-মহিষের ব্যবসা ঘিরে রাগারপাড় গ্রামের মৃত আফতর আলীর ছেলে নিহত আহাদ মিয়া এবং বিরেন্দ্রনগর গ্রামের মৃত আব্দুল গফুরের ছেলে আব্দুল আজিজের মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরিতা ছিল। ভারতীয় গরু-মহিষের ‘রশিদ’ (চিট) সংগ্রহ, মালামাল পরিবহন (কেয়ারিং) এবং সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের একক আধিপত্য নিয়ে এই দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।

আহাদ ও আজিজ একসময় ব্যবসায়িক অংশীদার থাকলেও নশিমপুর বাজারের ইজারা নিয়ে তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। আব্দুল আজিজ তাঁর খালাতো ভাই আব্দুল মতিনের নামে ইজারা নিলেও আহাদ মিয়ার প্রভাবে ব্যবসায়িক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তেন। ফলে আহাদ ওই বাজার এড়িয়ে বালিউড়া বাজার থেকে রশিদ সংগ্রহ করতেন। এ নিয়ে ইজারাদার কুদ্দুছের সাথেও আহাদের আর্থিক লেনদেন নিয়ে মনোমালিন্য হয়।

স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সূত্রগুলো জানায়, আহাদ মিয়ার বাধার কারণে আব্দুল আজিজ ও তাঁর রাজশাহী জেলাভিত্তিক মহাজন পিয়ারুলের সীমান্ত বাণিজ্য কয়েকবার বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। একে অপরের মালামাল বিজিবি বা প্রশাসনের মাধ্যমে আটকে দেওয়ার পাল্টাপাল্টি অভিযোগে কয়েক কোটি টাকার লোকসান হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, এই ক্ষতির ফলে আব্দুল আজিজ পিয়ারুলের কাছে প্রায় ২ কোটি টাকার বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সেই টাকা ফেরতের কোনো পথ না পেয়ে এবং ব্যবসায়িক চাপ থেকেই আহাদকে পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হতে পারে বলে স্থানীয়দের ধারণা।

পিয়ারুল গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় তিনি তাঁর দুই সহযোগী লতিফ ও তৈমুছকে সিলেটের হরিপুর এলাকায় সরিয়ে নিয়েছেন। তবে আজিজের কাছে তাঁর প্রায় ২ কোটি টাকা পাওনা থাকার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেছেন।

নিহতের পরিবারের দাবি, ঘটনার দিন রাতে আহাদ মিয়ার বাড়ির পেছনের একটি খড়ের ঘরে চারজন বসে মাদক সেবন করছিলেন। সেখানে মাদক সরবরাহ করতেন পূর্ব চাইড়গাঁও গ্রামের মুসলিম আলীর ছেলে রমজান আলী। পরিবার বলছে, ওই ঘর থেকে তাঁরা চারটি মদের বোতল, খাবারের প্যাকেট এবং আহাদের পরিহিত টি-শার্ট, একটি জুতা, গ্যাসলাইট ও একটি কাঠের রুল উদ্ধার করেছেন। এমনকি সেখানে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির জুতাও পাওয়া গেছে। পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ এসব আলামত জব্দ করতে অনীহা দেখিয়েছে। ঘটনার পর থেকে রমজান আলী পলাতক রয়েছেন।

পরিবারের অভিযোগ, আহাদকে গত ১৪ ডিসেম্বর রাতে তাঁর সহপাঠীরা বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। আইনি জটিলতা তৈরি করতে এবং বিষয়টিকে বিএসএফের গুলি বা সীমান্ত সংঘর্ষ বলে চালিয়ে দিতে হত্যাকারীরা লাশটি সীমান্তের প্রায় ১২০০ গজ ভেতরে ভারতের অংশে ফেলে রাখে। ১৫ ডিসেম্বর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কালাটেক এলাকায় তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়। ১৭ ডিসেম্বর বিএসএফ ও বিজিবি’র পতাকা বৈঠকের পর মরদেহ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সুরতহাল প্রতিবেদনে আহাদের গলায় ও শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।

এই হত্যাকাণ্ডের ৬ দিন পর গত ২১ ডিসেম্বর আব্দুল আজিজ, রমজান ও কুদ্দুছসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে দোয়ারাবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের বড় ভাই আ. কাইয়ুম। মামলার পর থেকেই আসামিরা পলাতক রয়েছে। স্থানীয়রা নজরুল ইসলাম নামে এক সন্দেহভাজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করলেও মূল পরিকল্পনাকারীরা এখনো অধরা।

দোয়ারাবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তরিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, “ঘটনাটি অত্যন্ত রহস্যজনক এবং গুরুত্বের সাথে তদন্ত করা হচ্ছে। ময়নাতদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ স্পষ্ট হবে। আলামতের বিষয়ে পরিবারের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।”

সচেতন মহলের মতে, দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকাটি অপরাধচক্রের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আহাদ হত্যার পরদিনও একই ইউনিয়নে এক অজ্ঞাত নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। একের পর এক এমন ঘটনায় এলাকায় চরম উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা এই ‘বর্ডার সিন্ডিকেট’ ভেঙে দিয়ে প্রকৃত খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।