রাউজানে বালু সিন্ডিকেট; আগে ছিল আ.লীগের এখন বিএনপির দখলে
২৪৬. ৫৮ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা। এ উপজেলা ভাগ হয়েছে দেশের একমাত্র মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী, কর্ণফুলী নদীর জল সীমানায় ও পার্বত্য জেলা রাঙামাটির পাহাড় পর্বত সীমানায়। এক সময় ভৌগোলিক দিক দিয়ে রাউজানের উপর দিয়ে প্রবাহিত দুই নদী ও প্রকৃতির পাহাড় পর্বতে সৌন্দর্য্য বর্দ্ধন উপজেলা ছিল। কিন্তু অপরিকল্পিত ভাবে অবৈধ বালু উত্তোলন ও পাহাড় টিলা কেটে সাবাড় করায় প্রকৃতির বিপর্যয়ে পড়েছে এ নান্দনিকতার উপজেলাটি।
বালু নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে:
২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগমুহূর্তে বালু মহালের একক নিয়ন্ত্রণ ছিল সাবেক এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী অনুসারীদের হাতে। পরর্বতীতে সবগুলো বালু মহাল নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সাবেক এমপি বিএনপির নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী অনুসারী নেতাকর্মীদের হাতে। গত ১৪ মাসে বালু মহাল নিয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে অন্ততপক্ষে অর্ধশতাধিক। এ নিয়ে খুনের ঘটনা ঘটেছে দুইটি।
সরকারী ও বেসরকারি খাতায় বালু মহালের সংখ্যাঃ উপজেলার ২৫ পয়েন্টে বালু উত্তোলন হচ্ছে বর্তমানে। উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি অফিসের তথ্য মতে বালু মহালের সংখ্যা ১০ টি। ইজারা আছে মাত্র ৪টি। তৎমধ্যে কর্ণফুলী নদীতে রয়েছে চার কোটি ঘনফুটের বড় বালু উত্তোলনের ইজারা। কর্ণফুলী নদীতে আরও একটি ২ লাখ ৫০ হাজার বর্গফুটের বড় বালু মহাল থাকলেও ইজারা হয়নি এটি। ইজারা না হওয়া এই বালু মহালে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন অব্যহত আছে।
ইজারা নেই ডাবুয়া খালের বালু উত্তোলন-১ ও ডাবুয়া খালের বালু উত্তোলন-২, রাউজান খাল পশ্চিম রাউজান মৌজার, সর্তা খালের চিকদাইর অংশ ও নোয়াজিশপুর অংশের বালু মহাল, ফটিকছড়ি ছড়া বালু মহাল ইজারা। কর্ণফুলী নদী বালু মহাল-১, সর্তার খালের উত্তর সর্তা বালু মহাল-১ ও সর্তার খালের উত্তর সর্তা বালু মহাল-২ ইজারা থাকলেও ইজার শর্ত অমান্য করে একাধিক পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলন করে ঝুঁকিতে পড়েছে নদী পাড়ের বসবাসকারী জনগোষ্ঠী। অনেক পরিবার নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে।
কর্ণফুলীর বাগোয়ান ইউনিয়ন অংশের পাঁচখাইন গ্রামের বাসিন্দা যুবদল কর্মী মোহাম্মদ সাব্বির হোসেন অভিযোগ করেছেন, কর্ণফুলীর ব্রীক ফিল্ড এলাকা হতে যুগি পড়া সুইচ গেইট এলাকা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে বালু উত্তোলন করতেন বোয়ালখালী উপজেলা আওয়ামী লীগ প্রভাবশালী নেতা বাপ্পী। সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যায় এ-ই নেতা। বর্তমানে তাঁর ভাই অভি বিএনপির কয়েকজনের সহযোগিতায় অবৈধ বালু উত্তোলন অব্যহত রেখেছেন।
সরকারি আইন অমান্য করে বালু উত্তোলন:
একসময় কয়েকটি পয়েন্টে ইজারা হতো প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীর বালু মহাল। হালদা নদীর জীব বৈচিত্র্য রক্ষা ও মৎস্য প্রজনন বাড়াতে হালদা নদী থেকে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ করেছে সরকার। মাছ শিকার ও বালু উত্তোলন বন্ধে নৌ পুলিশের সহযোগিতায় উপজেলা মৎস্য অফিস নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলে-ও অবৈধ বালু উত্তোলন ঠেকানো যাচ্ছে না। যার কারণে গত পাঁচ বছরে ৪৪টি ডলফিন ও শতাধিক মা মাছের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৮ অক্টোবর রাতে ২০ কেজি ওজনের একটি মরা কাতলামাছ উদ্ধার করার দুইদিন পর ৩০ অক্টোবর উদ্ধার করা হয় ৯ কেজি ওজনের আরও একটি কাতলামাছ। হালদার আবুরখীল নাপিতের ঘাট, সত্তার ঘাট এলাকা, মোবারকখীল, দক্ষিণ গহিরা ও ইছাপুর সড়কের লৌহার ব্রীজ সংলগ্ন এলাকার থেকে বালু উত্তোলন করছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে যাহা দেখা গেল:
কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট ব্রিজ হতে রাউজান, বোয়ালখালী ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শিলক ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার জলপথ। নদীর দুপাড়ে দেখা যায় বড় বড় সাদা বালু পাহাড়। রাউজান উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের পাঁচখাইন সুইস গেইট, ইউনিয়ন পরিষদের সম্মুখে, লাম্বুরহাট সুইস গেইট, খেলার ঘাট এলাকার সড়ক পাশে ছয়টি পয়েন্টে কয়েক লাখ ঘনফুটের বিশাল বিশাল সাদা বালুর স্তুপ। বালুর স্তুপে পাশে থাকা অফিস কক্ষে টাকা জমা দিয়ে রশিদ সংগ্রহ করে লাইন ধরেছে পরিবহনে নিয়োজিত ট্রাক। ট্রাকে ট্রাকে বালু নিয়ে ছুটছে নিজ গন্তব্যে। বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা হয় স্থানীয় লোকজনের সাথে।
পাঁচখাইন দরগা এলাকার ঔষধ দোকানী ফজর আলী বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে স্থানীয় চেয়ারম্যান ভূপেষ বড়ুয়াসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা কর্ণফুলী নদীর বালু নিয়ন্ত্রণ করতেন। এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। বালু ব্যবসার সাথে জড়িত যুবদল কর্মী মোহাম্মদ সোহেল বলেন, ইজারা নিয়ে বৈধ পন্থায় বালুর ব্যবসা পরিচালনা করছি আমরা। ইজারা প্রাপ্তির কাগজপত্র দেখিয়ে তিনি বলেন, আমরা কাউকে ঠকিয়ে ব্যবসা করছি না। বালু বেচাকেনার জন্য যে-ই মাঠ গুলো ব্যবহার করছি তাদের বাৎসরিক ইজারার টাকা পরিশোধ করেছি।
কামাল উদ্দিন নামে অপর এক যুবদল কর্মী বলেন, সরকার কর্ণফুলী নদী যেই চৌদি থেকে বালু উত্তোলনের শর্ত ছিল, সেই স্থান থেকে তোলা হচ্ছে। সর্তার খালের উত্তর সর্তায় একটি অংশে ইজারা নিয়ে বালু উত্তোলন করছে আরও তিনি পয়েন্ট থেকে। এসব বালু উত্তোলনে জরিত যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিএনপি নেতা মুসলেহ উদ্দিন, যুবদল নেতা পারভেজ, শফি।
রাউজান খালের ইজারা নেই, তবুও পূব রাউজান মৌজার দুই স্থানে অবৈধভাবে উত্তোলন করা করা হচ্ছে বালু। এ বালু ব্যবসায় জড়িত মাহাবুদ, জয়নাল, সোহেল। হালদা নদীর নোয়াজিশপুর ইউনিয়নের ইদ্রারাঘাট বাজার সংলগ্ন দুইটি স্থানে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন করছেন এলাকায় বালু যুবদল নেতা সেলিমের সহযোগী বখতিয়ার, জাহাঙ্গীর নেওয়াজ মিয়াঞ্জী, ফয়সালসহ একটি গ্রুপ।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন বলেন, ফয়সাল সহ কয়েকজন ইদ্রিরাঘাট এলাকায় বালু উত্তোলন করছে বলে শুনেছি। ডাবুয়া খালের আইলিখীল অংশে বালু উত্তোলন করছে যুবদল নেতা বদিউল আলম। কাশঁখালী খালের ঢেউয়াপাড়া মৌজায় বালু উত্তোলন নিয়োজিত যুবদল কর্মী নেজাম উদ্দিন।
বালু মহাল নিয়ে খুন হয় দুই যুবদল কর্মী:
মাটি ও বালু ব্যবসা নিয়ে খুন হয়েছে রাউজান বিএনপির দুই কর্মী। ১৫ মার্চ হলদিয়া ইউনিয়নের উত্তর সর্তা এলাকায় বালু-মাটি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও ইফতার মাহফিলে মাংস লুটের ঘটনা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়াকে কেন্দ্র করে বিএনপির দু'পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পিটুনী ও ছুরিকাঘাতে নিহত হয় কমর উদ্দিন জিতু (৩৬) নামে এক যুবদলকর্মীর। কর্ণফুলী নদী বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে উপজেলার শীর্ষ নেতার নির্দেশে দায়িত্ব পান করেন বিএনপির কর্মী ব্যবসায়ী আবদুল হাকিম (৫২)। এ বিপুল পরিমানের অর্থের উৎস ভালো চোখে নেননি অন্যান্য নেতাকর্মীরা। এ কারণে হাকিমের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায় বিএনপির অন্যান্য নেতাকর্মীদের মাঝে। গত ৭ অক্টোবর রাউজান থেকে চট্টগ্রাম শহরের বাসা ফেরার পথে হাটহাজারী- রাউজান উপজেলার সীমান্তবর্তী মদুনাঘাট ব্রীজ সংলগ্ন এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করে।
প্রশাসনের বক্তব্য:
রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাজেদুল ইসলাম জানান, বালু- মাটির নিয়ন্ত্রণ দেখেন উপজেলা প্রশাসন। উনারা আমাদের সহযোগিতা চাইলে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে থাকি। যেহেতু এ ব্যাপারটা দেখার জন্য নিজস্ব দপ্তর আছে, সেহেতু আমার থানায় এ ধরনের কোন অভিযোগ আসে না। আমি এমন অভিযোগ পাইনি।
উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি অংছিং মারমা বলেন, উপজেলার ১০টি বালু মহাল রয়েছে। সব কয়েকটিতে ইজারাদার টেন্ডারে অংশ না নেওয়ায় চারটি ইজারা হয়েছে। যদি অবৈধ উপায়ে কেউ নদী ও খাল থেকে বালু উত্তোলন ও বিক্রয়ে নিয়জিত থাকে অভিযান পরিচালনা করে এ-সব বালু মহাল বন্ধ করা হবে।




Comments