Image description

প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার ফল আমদানি করা হয়। এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় এবং দেশের ফলের চাহিদা মেটাতে বিদেশি জাতের ফল চাষে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছেন যশোরের মণিরামপুর উপজেলার মুজগুন্নি গ্রামের আব্দুল করিম। উপযুক্ত পরিকল্পনা আর কঠোর পরিশ্রমে তিনি গড়ে তুলেছেন খুলনা বিভাগের অন্যতম বৃহত্তম ও সফল কমলালেবুর বাগান। শূন্য হাতে শুরু করা আব্দুল করিম আজ দেশের কৃষি খাতে এক অনুপ্রেরণাদায়ী মডেলে পরিণত হয়েছেন।

আব্দুল করিমের এই যাত্রা সহজ ছিল না। ১৯৯৭ সালে খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে একটি নার্সারি দিয়ে তার পথচলা শুরু। ১২ বছর আগে তিনি যখন পরীক্ষামূলকভাবে চায়না কমলা চাষ শুরু করেন, তখন অনেকেই তাকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। কিন্তু দমে যাননি তিনি। বর্তমানে ২৫ বিঘা জমি জুড়ে তার বাগানে শোভা পাচ্ছে চায়না কমলা, হলুদ মাল্টা ও কুল। গাছে গাছে ঝুলে থাকা হাজার হাজার ফলের ভারে নুইয়ে পড়া ডালগুলো যেন এক সোনালি উৎসবের জানান দিচ্ছে। বর্তমানে বছরে প্রায় ৩০-৩৫ লাখ টাকা খরচ হলেও তার আয় দাঁড়ায় ৭০-৭৫ লাখ টাকায়। এছাড়া তার নার্সারি থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকার চারা বিক্রি হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

আব্দুল করিমের বাগানের কমলার মান শুধু স্বাদে নয়, বিজ্ঞানেও প্রমাণিত। ল্যাব টেস্টে দেখা গেছে, তার বাগানের প্রতিটি কমলায় রসের পরিমাণ ১৩ শতাংশ, যেখানে আমদানিকৃত বিদেশি কমলায় গড় রস থাকে মাত্র ৯ শতাংশ। ম ম গন্ধে ভরা এই রসালো কমলা সম্পূর্ণ নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত। স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি কমলা ১৫০ টাকা এবং মাল্টা ১৪০-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাগান থেকে সরাসরি কেনার জন্য দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা নিয়মিত ভিড় করছেন।

আব্দুল করিমের এই উদ্যোগ শুধু তাকেই স্বাবলম্বী করেনি, সৃষ্টি করেছে কর্মসংস্থানও। তার বাগানে বর্তমানে ২০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছেন, যাদের অধিকাংশেরই গ্রামীণ নারী। কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকরা জানান, এই বাগানে কাজ করে তারা আজ নিজের সংসার চালাতে পারছেন। এটি গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে।

আব্দুল করিমের এই নজরকাড়া সাফল্য দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। মণিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছাম্মদ মাহমুদা আক্তার বাগানটি পরিদর্শন করে বলেন, “আব্দুল করিম প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশের মাটিতেও বিদেশি জাতের ফল সফলভাবে উৎপাদন সম্ভব। সরকারি সহায়তা ও সঠিক প্রযুক্তি পেলে এমন বাগান আরও হাজারো কৃষকের ভাগ্য বদলে দিতে পারে।” কেশবপুর ভূমি অফিসের সার্টিফিকেট সহকারী হাদিউজ্জামান বলেন, এই বাগানটি আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

যশোরের উর্বর মাটি ও আব্দুল করিমের মতো পরিশ্রমী কৃষকদের হাত ধরে দেশি ফলের উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, সরকার যদি এই ধরনের উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, তবে বাংলাদেশ দ্রুতই ফল উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠবে।

আব্দুল করিমের এই কমলা বাগান এখন কেবল একটি কৃষি প্রকল্প নয়, এটি এক সফল স্বপ্নপূরণের নাম। তার ভাষায়, “মাটি শুধু ফসল ফলায় না, স্বপ্নও ফলায়।” মুজগুন্নি গ্রামের এই কৃষি বিপ্লব আজ সারা দেশের কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য এক আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে।