ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির নাম শুনলে দেহ-মনে চলে আসে প্রশান্তি। প্রশান্তি আনা শীতলপাটি এক সময় বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে শোভা পেত। বাঙালির সংস্কৃতির চিরায়ীত শীতলপাটির শিল্পীদের কথা বার বার উঠে আসে ইতিহাসে। এই শিল্পটির খ্যাতি ছিল পুরো বাংলাদেশ জুরে। নানামুখী সমস্যার কারণে জামালগঞ্জের শীতলপাটির খ্যাতি আজ বিলুপ্তির পথে। অথচ সরকারি সহযোগিতার হাত বাড়ালে এই শিল্পটি বিকাশে সম্ভাবনা রয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির শিল্পীরা আজ আর্থিক অনটনে দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি, পাটি তৈরি উপকরণের সল্পতা, প্লাস্টিকের পাটি তৈরির প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতা সল্পতার কারণে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাপ-দাদার প্রায় দেড়শ বছরের শিল্প এখন হুমকির মুখে।
এরপরও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে উপজেলার সদর ইউনিয়নের কদমতলী, সোনাপুর, দূর্গাপুর, ভীমখালী ইউনিয়নের কালীপুর গ্রামের কয়েক শত পরিবার। সাহায্য-সহযোগীতার আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে উপজেলার চারটি গ্রামের তিনশত পরিবার চরম দুর্দিনের মধ্যে কাটাচ্ছে। বাজার উর্ধ্বগতি আর শীতলপাটির ন্যায্য মূল্যের অভাবে পূর্বপুরুষদের এই শিল্পটি ধরে রাখতে পারছে না।
শীতলপাটি তৈরির একমাত্র কাঁচামাল হচ্ছে মুর্তা নামক এক জাতীয় গাছ। এই সব গ্রামের আশেপাশে তিন দশক আগেও ৫০ থেকে ৬০ বিঘা জমিতে মুর্তা চাষ হতো। এসব জমির মালিক অত্র গ্রামের বাসিন্দাদের ছিল। কালের পরিবর্তনে সাংসারিক টানাপোড়েনে এসব জমি বিক্রি করায় বর্তমান জমি মালিকেরা ধান সহ বিভিন্ন শাক-সবজি চাষ করছেন। তাই মুর্তা চাষীরা অনেকেই এখন নিঃস্ব ও অসহায় হয়ে পড়েছেন। এক সময় পরিবারের পুরুষেরা মুর্তা চাষে ব্যস্ত থাকতেন আর নারীরা পাটি বুননের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। এই পাটি শিল্পটি ছিল পরিবারের ঐতিহ্য ও আয়ের উৎস। বছরের পর বছর ধরে এ কাজ করে যাওয়া পরিবারগুলো আজ নানামুখী সমস্যায় ভুগছে। এলাকায় তাদের নিজস্ব জমি বিক্রি করায় অন্যরা এই পেশায় না থাকার কারণ তাদের জমিতে মুর্তা চাষের বদলে তাদের চাহিদা মতো ধান সহ বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজি চাষ করছেন। ফলে পর্যাপ্ত মুর্তা না পাওয়ার কারনে পেশাটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এক দশক আগেও এক পন মুর্তা একশত টাকায় পাওয়া যেত, বর্তমানে সেই মুর্তা বিভিন্ন এলাকা থেকে কিনতে হচ্ছে সাতশত থেকে আটশত টাকায়।
সরেজমিনে জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষের কর্ম ব্যস্ততার শেষ নেই। কেউ যার যার উঠানে বসে পাটি বুনছে, কেউ মুর্তা কাটছে, আবার কেউ মুর্তা গাছের বেত ছড়াচ্ছেন। প্রতিটির বাড়ির আঙ্গিনায় কিংবা বারান্দায় সমানতালে পাটি বুনন চলছে।
শীতলপাটি যে সকল শিল্পীরা তৈরি করে তাদের মধ্যে সুজাতা রানী কর, সুমতি রানী কর জানান, এই পেশাটি যুগের পর যুগ বংশানুক্রমে চলে আসছে। তারা ছোটবেলা থেকেই এই পেশার সাথে জড়িত রয়েছেন। তাদের পরিবারের ৮ থেকে ১০ জন রয়েছেন। তারা সকলে মিলেমিশে পাটি বুনন করেন। পরিবারের সম্বলিত প্রচেষ্টায় একটি পাটি তৈরি করতে ৪ থেকে ৫ দিন সময় লাগে। তাদের তৈরি করা পাটি বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে নিয়ে যায়। আর কেউ কেউ স্থানীয় সাচনা বাজারে গিয়ে বিক্রি করেন। একটি শীতলপাটি ১২০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকায় বিক্রি হয়। আবার কেউ বিভিন্ন নকশাসহ অর্ডার করলে ৮ থেকে ১০ হাজার নেওয়া হয়। কিন্তু মুর্তার আকাশচুম্বী দাম থাকায় এখন আর আগের মতো লাভ হয় না। পুঁজির সব টাকাই মুর্তা কিনতে শেষ হয়ে যায়। পরিবারের সবাই মিলে মাসে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা আয় হয়। সামান্য আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।
রত্না রানী করের স্বামী সুবল চন্দ্র কর জানান, পাটি তৈরি করে যা আয় করি তা দিয়ে সংসার চলতে কষ্ট হয়। অপরদিকে সুপ্রতি রানী কর জানায়, শিশু বয়স থেকে এই কাজ করে আসছি। বাবার সংসারেও এই কাজ করতাম আবার স্বামীর সংসারেও এই কাজ করছি। বর্তমানে আমরা বড় সমস্যার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। আগে মুর্তা ছিল ৬ থেকে ৭ ফুট লম্বা। তাই ৫ থেকে ৬ ফুট লম্বা পাটি জোড়া না দিয়েই তৈরি হতো। এখন মুর্তা ৩ থেকে ৪ ফুট হওয়ায় জোড়া দিয়ে পাটি তৈরি করতে হয়। আর এইজন্য পাটির দাম ভাল পাওয়া যায় না। আগে আমাদের নিজেদের মুর্তার জমি ছিল। এখন আর তা নেই। অভাবের তাড়নায় মুর্তা জমি বিক্রি করে দিয়েছি। মুর্তা বিভিন্ন এলাকা থেকে আনতে চার থেকে পাঁচ দিন সময় নিয়ে বেশ দাম দিয়ে আনতে হয়। যার কারণে আগের মত লাভ হয় না। অন্যের জমিতে শ্রমিকেরা প্রতিদিন যে মজুরি পায় সেই তুলনায় ঐতিহ্যের শীতলপাটি তৈরি করে তার অর্ধেক টাকাও রুজী হয় না।
কালের আবর্তমানে এই উপজেলায় কদমতলী, সোনাপুর, দূর্গাপুর, কালীপুর গ্রামের পাটি শিল্পের বয়স প্রায় দেড় শত বছর।
পাটি শিল্পের জন্য বিখ্যাত হওয়ায় এই গ্রামগুলোকে পাটি শিল্পের গ্রাম বলা হয়। কদমতলী গ্রামের নারায়ন নন্দি জানান, কয়েক যুগ আগে সম্বলিত সবার প্রচেষ্টায় বেসরকারি সংস্থা আইডিয়ার মাধ্যমে কিছু ঋনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখন এই সংস্থাটির প্রকল্পটি না থাকায় তা এখন বন্ধ হয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, সরকারি কোন প্রতিষ্ঠান কিংবা তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুর্তা চাষীদের খাস জমি বন্দোবস্ত দিলে এবং সরকারি যে কোন ব্যাংক থেকে বার্ষিক কিস্তিতে ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে ঐতিহ্যের পাটি শিল্পটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময়ী হতে পারে। নতুবা কালের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে এই শিল্পটি এক সময় হারিয়ে যাবে।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সাব্বির সারোয়ার জানান, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালে ৪০ জন পাটি শিল্পীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ১৮ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রকল্পটি পুনরায় চালু হলে এদের জীবনমান উন্নয়নে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।




Comments