Image description

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। মাটি ও পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষিজমি কমছে, মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং বরফ গলনের ফলে এই সংকট আরও তীব্র হচ্ছে।

কৃষিজমি ও জনজীবনে বিপর্যয়

গবেষণায় দেখা যায়, গত ১০ বছরে দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, সাতক্ষীরা, এবং পটুয়াখালীর মতো জেলাগুলোতে কৃষিজমি প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গেছে। এই অঞ্চলগুলোতে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশের কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আগে যেখানে বছরে দুই থেকে তিনটি ফসল উৎপাদন সম্ভব ছিল, এখন অনেক জমিতে কেবল আমন ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। সুপেয় পানির সংকট বাড়ছে, এবং অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. খন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, “মানুষ বাধ্য হয়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। আগামী ২০৪০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ৪০ মিলিয়নে পৌঁছাতে পারে। ফারাক্কা বাঁধসহ বিভিন্ন কারণে মিঠা পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় লবণাক্ততা আরও বাড়ছে। এটি ভবিষ্যতে বড় ধরনের নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করবে।”

কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তীব্র তাপমাত্রা বৃদ্ধি কৃষি, ডেইরি, এবং পোলট্রি শিল্পের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। অতি গরমে ডেইরি ও পোলট্রি ফার্মগুলোতে মড়ক দেখা দিচ্ছে, এবং সেচের জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আম, লিচুর মতো ফলের উৎপাদন কমছে, যা খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোলাম হাফিজ কেনেডী বলেন, “আগে যে জমিতে দুটি সেচে ফসল উৎপাদন সম্ভব ছিল, এখন সেখানে পাঁচ থেকে নয়টি সেচ প্রয়োজন। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, আর কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ফসল উৎপাদন কমে গেলে খাদ্যের সরবরাহ হ্রাস পাবে, যা খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে তুলবে। পুষ্টিসমৃদ্ধ ফলমূল ও শাকসবজির উৎপাদনও আশঙ্কাজনক হারে কমে যেতে পারে।”

লবণাক্ততার ভয়াবহতা

বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর মাটি ও পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বাড়ছে। পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় পরিমাপের তথ্যে দেখা যায়, বরগুনা সদর উপজেলার উত্তর হেউবুনিয়া এলাকার মাটিতে লবণাক্ততার মাত্রা ১৫.৫৯ ডিএস/মিটার, যা অত্যধিক লবণাক্ত হিসেবে চিহ্নিত। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নাচনাপাড়ায় মাটির লবণাক্ততা ৮.৭১ ডিএস/মিটার, যা মাঝারি মানের লবণাক্ত জমি।

নদীর পানিতেও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে পটুয়াখালীর তেতুলিয়া নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা ছিল ০.৬০ ডিএস/মিটার, যা সেচের জন্য নিরাপদ ছিল। কিন্তু ২০২৫ সালের এপ্রিলে তা বেড়ে ১.৮৫ ডিএস/মিটারে দাঁড়িয়েছে, যা সেচের জন্য ক্ষতিকর। একইভাবে, গলাচিপা নদীতে লবণাক্ততা ০.৬৯ থেকে বেড়ে ২.৫৬ ডিএস/মিটারে এবং লোহালিয়া নদীতে ০.৫৫ থেকে ১.৩৫ ডিএস/মিটারে উন্নীত হয়েছে।

পেশা ও বাসস্থান পরিবর্তনের চাপ

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকার মানুষ পেশা ও বাসস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর ফলে ঢাকার মতো শহরগুলোতে জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদা পারভীন বলেন, “লবণাক্ততার কারণে কৃষিজমি ও ফসলের উৎপাদন কমছে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।”

সমাধানের পথ

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাতক্ষীরা উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. বাবুল আক্তার বলেন, “লবণাক্ততার কারণে কৃষিজমি কমছে। আমরা লবণাক্ততা সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা করছি।” কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নজরুল ইসলাম জানান, “অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, তাপদাহ, এবং খরার কারণে কৃষকদের ঝুঁকি বেড়েছে। আমরা কৃষকদের লবণাক্ততা সহনশীল ফসল চাষে উৎসাহিত করছি।”

জলবায়ু পরিবর্তনের এই সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত পদক্ষেপ, গবেষণা, এবং নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। অন্যথায়, উপকূলীয় এলাকার খাদ্য নিরাপত্তা ও জীববৈচিত্র্যের ওপর এই হুমকি আরও তীব্র হবে।