Image description

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিশাল একটা অংশ বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে ২০০৫ সালে গঠিত হয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। ২০১৫ সালে ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ (স্বজনপ্রীতি ও ঘুষবাণিজ্য) বন্ধ করে, এনটিআরসিএ-কে সেন্ট্রালি নিয়োগ সুপারিশের অনুমতি প্রদান করে মন্ত্রণালয়। 

এদিকে ১-১২তমদের (এন্ট্রিলেভেল মার্ক-৪০ পেলেই নিয়োগ যোগ্য বিবেচিত হওয়ায়) অতিরিক্ত মার্কের কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। তাই ইতোমধ্যে উত্তীর্ণ সবাইকে নিয়ে মেধা তালিকা করায়, কোনো কোনো ব্যাচ লাভবান হলেও কোনো কোনো ব্যাচের একেবারে বিনা কারণেই সর্বনাশ হয়ে যায়। 

অপরদিকে সুপারিশ প্রক্রিয়া এনটিআরসিএ’র হাতে আসায় পরবর্তিতে উত্তীর্ণ ১৩তম, ১৪তম, ১৫তম, ১৬তম ১৭তমরা প্রতিযোগিতা করে বেশি নাম্বারসহ উত্তীর্ণ হয়ে সুপারিশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগায় এবং প্রায় সকলেরই নিয়োগ হয়ে যায়। পদ্ধতির পরিবর্তন হলে মূল্যায়নের সবকিছুই ওলট-পালট হয়ে যায়। সেগুলো সমন্বয়ের জন্য যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে উত্তীর্ণ এক ঝাঁক স্নাতক-স্নাতকোত্তর করা বিষয়ভিত্তিক নিবন্ধিত শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়ার কাজটা সহজ ও স্বচ্ছ হওয়ার কথা। কিন্তু এনটিআরসিএ’র দায়িত্বহীনতা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিছু কার্যক্রমে সবকিছুই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। 

এনটিআরসিএ’র ভুল: অন্য ১০টি পরীক্ষার মতো শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নিবন্ধিত শিক্ষকদের ইউনিক আইডি (রোল) প্রদান না করা; সম্মিলিত মেধাতালিকা প্রণয়ন করা হলেও পিক অ্যান্ড চুজ পদ্ধতিতে নিয়োগ সুপারিশ করা; সম্মিলিত মেধাতালিকা ১-১৭টি ব্যাচে উত্তীর্ণদের অ্যাড করা, কিন্তু সুপারিশ প্রাপ্ত ইনডেক্সধারীদের তালিকা বহির্ভূত বা পৃথক না করা; এন্ট্রিলেভেল নিবন্ধিত শিক্ষকদের সাথে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের নিয়োগ সুপারিশের সুযোগ রেখে প্রকৃতি পক্ষে বদলি বাস্তবায়ন করা; প্রতি গণবিজ্ঞপ্তির শূন্যপদগুলো আবেদনকৃত যোগ্য প্রার্থী দ্বারা পূরণ না করে প্রকান্তরে কৃত্রিম শিক্ষক সংকট তৈরি করা; একই প্রতিষ্ঠানে প্রতি গণবিজ্ঞপ্তিতেই একই ব্যক্তির আবেদন গ্রহণ করা এবং যোগ্য প্রার্থী থাকার পরও নতুন (ক্ষেত্রবিশেষ স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে) প্রার্থী খোঁজা এবং ক্রমান্বয়ে অপেক্ষমাণ যোগ্যদের তালিকা দীর্ঘায়িত করা এবং সনদ বাণিজ্য করা; অপরদিকে নিবন্ধিত সনদসংখ্যা ছয় লাখ অতিক্রম করলেও প্রকৃত চাকরিপ্রত্যাশী (চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি অনুসারে স্কুল-কলেজের বিপরীতে ৮১ হাজার) শিক্ষকদের নিয়োগজনিত উদ্যোগ সরকারি বাজেটের অন্তরায় দেখিয়ে দ্বিমাতাসুলভ আচরণ করা; নিবন্ধিত নিয়োগ প্রার্থীদের এন্ট্রিলেভেল বয়স বিবেচনা না করা, ক্ষেত্রবিশেষ বিজ্ঞ আদালতের রায় প্রয়োগ না করে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা।

এনটিআরসিএ’র দুর্নীতি: বিভিন্ন দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার তথ্যমতে এনটিআরসিএ’র চেয়ারম্যানের গাড়িচালক ও সিস্টেম অ্যানালিস্ট দায়িত্বশীলদের যোগসাজশে অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে দুই লাখ টাকায় উচ্চমার্কের সনদ প্রদান এবং ছয় লাখ টাকায় নিয়োগ সুপারিশ করে প্রকান্তরে বৈধ সনদধারীদের নিয়োগ বঞ্চিত করে রেখেছে; নিয়োগের উদ্দেশ্যে সব শর্তে উত্তীর্ণদের শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানে সুপারিশের উদ্দেশ্যে (গণবিজ্ঞপ্তিতে) নির্ধারিত ফি’র বিপরীতে আবেদন গ্রহণ করে এনটিআরসিএ। অথচ প্রথম গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনকৃত প্রার্থীর আবেদনের বিপরীতে শূন্যপদ পূরণ না করে দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে আবার ওইসব পদে শিক্ষক চাহিদা নেয়া হয়। একইভাবে দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তির ফাঁকাপদে তৃতীয়তে গণবিজ্ঞপ্তিতে, তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির ফাঁকাপদে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে নেয়া হয়। পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিও এর ব্যতিক্রম নয়।

২০১৬ সালে এনটিআরসিএ ১৬০০০ পদের বিপরীতে প্রথম গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। কিন্তু পদ্ধতিগত ভুলের কারণে একই ব্যক্তি নিজ উপজেলার একাধিক প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে মোট ৩৯ হাজার ৫৩৫টি শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন এনটিআরসিএ। ৩৪ হাজার শিক্ষক দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পেলেও বেশিরভাগ ছিল ইনডেক্সধারী। ২০২০ সালের ৩১ মার্চ ৫৪ হাজার ৩০৪টি পদের বিপরীতে প্রকাশিত হয় তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি। 

বদলি ব্যবস্থা না থাকায় দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ইনডেক্সধারী শিক্ষকসহ এন্ট্রিলেভেল শিক্ষক নিয়োগ আবেদন করেন তৃতীয় নিয়োগ চক্রে। তৃতীয় চক্রে জয়েন করেন (ইনডেক্সধারী ব্যতীত) মাত্র ১৪ হাজারের মতো। পদ শূন্য থাকে প্রায় ৪০ হাজারের উপরে। চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির পরও দেখা যায়, ৬৮ হাজার শূন্য পদের মধ্যে আবারও ফাঁকা থাকে ৪০ হাজার। 

বছরের পর বছর চাহিদা দিয়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক পাচ্ছে না, অথচ পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তির ৯৭ হাজার শূন্য পদের মধ্যে ফাঁকা রয়েছে ৭৮ হাজার পদ। বিচার বিভাগের রায়কে পাশ কাটিয়ে ক্ষেত্রবিশেষ ঢাল হিসেবে ব্যবহার ( মামলার আপিল বা রিভিউ সচল) করে এবং বিদ্যমান আইনের বাইরে কিছু করার নেই অজুহাতে কালক্ষেপণসহ নিবন্ধিতদের একটা অংশকে প্রকান্তরে দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগ সুপারিশ কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

এনটিআরসিএ’র সিস্টেম-দুর্নীতি: ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে অধিক ক্ষতিকর অবৈধ সনদ ও আর্থিক বিনিময়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত অবৈধ শিক্ষক দ্বারা শিক্ষাক্ষেত্র কলুষিত করছেন, অন্যদিকে প্রকৃত মেধাবীদের করেছেন বঞ্চিত। ভুক্তভোগী প্যানেলপ্রত্যাশী নিবন্ধিত শিক্ষক সংগঠন ২০২২ সালের ৫ জুন থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০০ দিন শাহবাগে সকাল-সন্ধ্যা আেেন্দালন করে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনির সঙ্গে আলোচনার টেবিলে এনটিআরসিএ’র দুর্নীতির বিষয় তুলে ধরলে তিনি ভুক্তভোগীদের বিপরীতে অবস্থান নেন। পরবর্তী শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল জাতীয় সংসদে (৯৭ হাজার শূন্যপদে ১৯ হাজার শিক্ষকের নিয়োগ কার্যক্রম চলমান রেখে) গত ছয় মাসে ৯৯ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন বলে মিথ্যাচার করেন।

পিক অ্যান্ড চুস পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক নিয়োগ সুপারিশ কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় হাজার হাজার প্রার্থী আবেদন করেও নিয়োগ বঞ্চিত। এনটিআরসিএ’র এ কৌশলগত চরম রসিকতার বিরুদ্ধে প্যানেলপ্রত্যাশী নিবন্ধিত শিক্ষক সংগঠন নিবন্ধিত শিক্ষকদের প্যানেলপ্রত্যাশী নিবন্ধিত শিক্ষক সংগঠনের ব্যানারে দীর্ঘ ২০০ দিনের আন্দোলনের ফলে শিক্ষক নিয়োগের অনুসরণীয় প্রদ্ধতির ৭নং পয়েন্ট (ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ) স্থগিতের মাধ্যমে এন্ট্রিলেভেলের শিক্ষক দ্বারা সকল পদ পূরণের লক্ষ্যে নিয়োগ আবেদনেরও পরিবর্তন আনে এনটিআরসিএ। 

একজন প্রার্থী স্কুল-কলেজ এই দুই লেভেলের জন্য দুটি আবেদন করতে পারবেন এবং প্রত্যেক আবেদনের বিপরীতে চল্লিশটি প্রতিষ্ঠান চয়েস থাকবে। কেউ কলেজ নিবন্ধনের বিপরীতে নির্বাচিত না হলে স্কুল নিবন্ধনের বিপরীতে বিবেচনা করা হবে। এই দুটি প্রক্রিয়ায়ও যদি নির্বাচিত না হয় তবে, শূন্যপদ থাকা সাপেক্ষে সারা বাংলাদেশের যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে ইচ্ছুক হলেও থাকবে ‘‘ইয়েস অপশন’’। কিন্তু চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির প্রাথমিক সুপারিশে দেখা গেল, ৬৮ হাজার শূন্য পদে সুপারিশ পেল মাত্র ২৭ হাজার, চূড়ান্ত নিয়োগ পেল আরও কম। আবারও পদ ফাঁকা থাকল ৪০ হাজারের উপরে। ধরা যাক- ‘ক’ নামক ব্যক্তি স্কুল ও কলেজ উভয় নিবন্ধনের বিপরীতে আবেদন করেছে। ‘ক’-এর আবেদনকৃত কলেজ শাখার ৯টি প্রতিষ্ঠান এবং স্কুল শাখার ১১টি প্রতিষ্ঠানে পদ ফাঁকা থাকে। 

মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশা টানছে না, কথাটি মুখ্য নয় গৌণ। শিক্ষক সংকট দূর করতে এনটিআরসিএ’র হাতে পর্যাপ্ত শিক্ষকও আছে। বছরের পর বছর চাহিদা দিয়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক পাচ্ছে না। চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগ প্রার্থীর জাতীয় পরিচয় পত্রের বিপরীতে স্কুল-কলেজ মিলে প্রকৃত নিয়োগ প্রত্যাশী হিসেবে আবেদন পড়ে মাত্র ৮১ হাজার। নিয়োগের আশ্বাস দিয়ে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সরোজ কুমার নাথ প্যানেলপ্রত্যাশী নিবন্ধিত শিক্ষক সংগঠনের নিয়োগ বঞ্চিতদের ২১ হাজার ৭৯৬ জনের একটি তালিকাও গ্রহণ করেছিলেন।

নিয়োগ বঞ্চিত বৈষম্যের শিকার ২১ হাজার ৭৯৬ জন প্যানেল করে নিয়োগের জন্য বারবার আন্দোলন করছে। বর্তমানে শূন্যপদ ৭৮ হাজার। জাল সনদে চাকরিরতদের চাকরিচ্যুত এবং প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সঠিক শূন্যপদের চাহিদা নিলে শূন্যপদ প্রায় দেড় লাখের উপরে হবে। বর্তমানে আগামী তিন বছরের শূন্যপদের চাহিদা নেয়া হচ্ছে। এতে শূন্যপদ দুই লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। এনটিআরসিএ যে উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল তা যথাযথ অনুসরণ না করে দায়িত্ব অবহেলাসহ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যুগোপযোগী শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিকে বিতর্কিত করছে। 

বছরে একাধিক বার পরীক্ষা নিয়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার প্রার্থী যোগ করা হলেও নির্ধারিত সময়ে (গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে) নিয়োগ সুপারিশ করা হয় না। এমনকি ৫০ হাজার যোগ করা হলেও ফ্রেস নিয়োগ পান এক-পঞ্চমাংশেরও কম। শিক্ষকদের শতভাগ বেতন-ভাতা প্রদান করতে হবে। দূর-দূরান্তে চাকরিরত শিক্ষকদের বদলি ব্যবস্থা গ্রহণ একটি যোগান্তকারী পদক্ষেপও বটে। 

প্রয়োজনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু তারও আগে এনটিআরসিএ’র কৌশলে বারবার নিয়োগ বঞ্চিত একঝাঁক স্নাতক-স্নাতকোত্তর করা বিষয়ভিত্তিক নিবন্ধিত প্রকৃত চাকরিপ্রত্যাশীদের এন্ট্রিলেভেল বয়স বিবেচনা করে বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও স্বেচ্ছাচারিতায় (১ম থেকে ৫ম) গণবিজ্ঞপ্তিতে বৈষম্যের শিকার, নিয়োগ বঞ্চিত নিবন্ধিত শিক্ষকদের নিয়োগ প্রদান করে বৈষম্যমুক্ত শিক্ষা ও জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাব্যবস্থা কলঙ্কমুক্ত করা এখনই হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।