Image description

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন এবং দেশীয় রাজনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বেগম খালেদা জিয়া আর নেই। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অবসান হলো বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘ চার দশকের এক ঘটনাবহুল অধ্যায়ের।

বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল এক শোকাবহ পরিবেশে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও তার স্বামী জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর গভীর সংকটে পড়ে বিএনপি। দলের অস্তিত্ব রক্ষায় ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে পা রাখেন তিনি। ১৯৮৩ সালে তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ৪১ বছর তিনি এই পদে আসীন ছিলেন।

নব্বইয়ের দশকে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে রাজপথের লড়াকু সৈনিক হিসেবে আবির্ভূত হন খালেদা জিয়া। আট বছরের দীর্ঘ সংগ্রামে তিনি সাতবার অন্তরীণ হন, কিন্তু কোনো দিন আপস করেননি। এই আপসহীন দৃঢ়তার কারণেই তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে দেশজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি বাংলাদেশের প্রথম এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাস গড়েন। তার সময়েই দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তিত হয়। এরপর ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে তিনি আরও দুবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বিরল কৃতিত্ব হলো, তিনি তার ৪১ বছরের জীবনে কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনে তিনি একাধিক আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং সবকটি আসনেই জয়ী হয়েছেন। এমনকি ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনটি নির্বাচনে তিনি পাঁচটি করে আসনে জয়লাভ করার রেকর্ড গড়েন।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহুবার কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এবং ২০১৮ সালে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে তিনি কারাবন্দি হন। কারাগারে থাকাবস্থায় তিনি হারিয়েছেন গর্ভধারিণী মাকে। এছাড়া ২০১৫ সালে রাজনৈতিক উত্তাল সময়ে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু ছিল তার জীবনের এক অপূরণীয় ক্ষতি। ২০১০ সালে আদালতের আদেশে তাকে ছাড়তে হয়েছিল দীর্ঘদিনের স্মৃতিবিজড়িত মইনুল রোডের বসতবাড়িও।

২০১৮ সাল থেকে কারাবন্দি থাকার পর ২০২০ সালে করোনা মহামারীর সময় মানবিক বিবেচনায় শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান তিনি। দীর্ঘ সময় গুলশানের বাসভবন 'ফিরোজা' এবং হাসপাতালে কাটানোর পর ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক মুক্তি লাভ করেন।

১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুরে জন্মগ্রহণ করা খালেদা জিয়ার আদি নিবাস ছিল ফেনীর ফুলগাজী থানায়। ১৯৬০ সালে জিয়াউর রহমানের সাথে তার বিবাহ হয়। তিনি দুই পুত্রসন্তান—তারেক রহমান ও প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর জননী।

বাংলাদেশের রাজনীতির পালাবদল, গণতন্ত্রের সংগ্রাম এবং নারীর ক্ষমতায়নে বেগম খালেদা জিয়ার নাম ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় হয়ে থাকবে। ২০২৬ সালের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে তার অংশগ্রহণের প্রস্তুতি থাকলেও, শারীরিক অসুস্থতা শেষ পর্যন্ত তাকে চিরবিদায়ের পথে নিয়ে গেল।

মানবকন্ঠ/আরআই