Image description

নদী কেন কথা কয় না, গান গায় না, বয়ে চলে না! চপলা কিশোরীর মতো আপন গতিবেগ কোথায় হারাল সে? দৃশ্যটি কল্পনা করতে কেমন লাগবে ‘নদীমাতৃক’ বাংলাদেশে কোনো নদীই নেই! বাংলাদেশকে জালের মতো বেষ্টন করে ছিল যে নদী, রেখেছিল পরম মমতার চাদরে ঢেকে, দিয়েছিল ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ অভিধা সেই দৃশ্যকল্প এখন যেন কল্পনার ফানুস হয়ে উঠছে। 

কোথায় নদী? যেসব নদী এখনো টিকিয়ে রেখেছে অস্তিত্ব- কোনোটিতে পানি নেই; পারাপার হওয়া যায় হেঁটে; ‘বৈশিষ্ট্য’ ধরে রাখা কিছু নদী আবার এত সরু হয়ে গেছে পরিচয় বলে না দিলে আগন্তুক সেটাকে খাল কিংবা নালা হিসেবেই ভেবে নেবে! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’তে তবু বৈশাখ মাসে হাঁটুজল থাকত, এখনকার নদীগুলোতে কোনো মাসেই কি তবে জল রইবে না? ‘জল ভরিবার ছল করিয়া’ কিশোরী থেকে যৌবনে পদার্পণ করা প্রান্তিক মেয়েদের প্রেমও কি তবে থমকে থাকবে! এমন প্রতিবন্ধকতা, অনিশ্চয়তার দোলাচল কেন? নদীমাতৃক বাংলাদেশের এমন বেহাল দশা কাম্য ছিল না। 

পাল তোলা নৌকাকে পাল গুটিয়ে নিতে হবে, সে পাততাড়ি হবে দীর্ঘস্থায়ী তা কি স্বপ্নেও ছিল! অথচ সেটাই এখন চরম বাস্তবতা। যে দেশের নদী কথা কইত নারীর মতো, সেই জবান স্তব্ধ! টাইম মেশিনে একটু পিছু ফেরা গেলে কেমন দেখা যাবে নদীর চেহারা, বোঝা যাবে নদীবিষয়ক কথকতা!
ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে...। শিল্পীর গানের কথায় মূর্ত হয়ে ওঠে নদী-চরিত্র। আমাদের নদীর কাছে যেতে হবে, নদীর কথা শুনতে হবে, নদীকে জানতে হবে। তবেই হবে নিজেকে জানা, স্বদেশকে জানা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এ গান স্মরণ করিয়ে দেয় নদীর কথা, টেনে নিয়ে যায় নদীর কাছে। নদীর মোহনায় ছুটে যায় মন। 

নদীপাড়ের খোলা হাওয়া ভরিয়ে দেয় শরীর-মন। দেশজুড়ে রয়েছে অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর, দিঘি, জলাশয়। এগুলোকে চিনলেই বাংলাদেশকে চেনা হবে। জানতে হবে নদ-নদীর উৎপত্তি ও সর্বশেষ অবস্থা। প্রায় প্রতিটি জেলার ওপর দিয়েই বয়ে গেছে এক বা একাধিক নদী। কথায় বলে, বাংলাদেশ ধানের দেশ, পাটের দেশ, আবার নদীরও দেশ! সব নদীর নাম মানুষ তেমনভাবে না জানলেও কিছু কিছু নদীর নাম মুখে মুখে ফেরে। 

চট্টগ্রামের কর্ণফুলি, হালদা; ঢাকার বুড়িগঙ্গা; গাজীপুরের তুরাগ; চাঁদপুরের মেঘনা; বরিশালের কীর্তনখোলা, মেঘনা, আডিয়াল খাঁ, তেঁতুলিয়া; সিরাজগঞ্জের যমুনা; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস; যশোরের কপোতাক্ষ নদ; সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা; বগুড়ার করতোয়া; নাটোরের পদ্মা; ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র; বান্দরবানের শঙ্খ বা সাঙ্গু; লক্ষ্মীপুরের মেঘনা; নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা; ঝিনাইদহের চিত্রা; সুনামগঞ্জের কালনী; পিরোজপুরের মধুমতি ইত্যাদি। আবহাওয়া ও ঋতুচক্র পরিবর্তনের কারণে প্রায় বছরই বাংলাদেশে বন্যা হয়। বন্যাপ্লাবিত পানিতে ডুবে যায় বিল, ক্ষেত-খামার। বন্যায় মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ে। আবার এ বন্যার পানিই যখন নেমে যায় তখন অভিশাপ আশীর্বাদ হয়ে ধরা দেয়! পানি দিয়ে যায় বহন করে আনা পলিমাটি, যে পলিমাটিতে বাম্পার ফলন হয়। হাসি ফোটে কৃষকের মুখে। 

বাংলাদেশিদের জন্য নদী কখনো সর্বনাশা আবার কখনো পরম উপকারী বন্ধু। নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায় অনেকের বাড়িঘর, করালগ্রাসে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসতে হয়। এছাড়াও বন্যায় যখন কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল নষ্ট হয়ে যায় তখন হাহাকারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার কৃষিকাজের জন্য নদীর পানি অপরিহার্য। নদী শুধু সৌন্দর্যের আকর কিংবা যাত্রা-সহায়কই নয়- মাছ, শুঁটকি শামুক-ঝিনুকের যোগানদারও। আমাদের মৎস্য চাহিদার সিংহভাগই পূরণ করে নদী। নদীর ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে জেলে সম্প্রদায়। মৎস্য আহরণ করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়।

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী হিসেবেও মৎস্যশিল্পের ভ‚মিকা কম নয়। রপ্তানিকৃত মাছের মধ্যে ইলিশ ও চিংড়ি প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। বহির্বিশ্বেও বাংলাদেশের ইলিশ দারুণ জনপ্রিয়। নৌপথে মালামাল আনা-নেয়ায় নদীর ভ‚মিকা ব্যাপক। চট্টগ্রাম-খুলনার নৌবন্দর কর্মচাঞ্চল্যে মুখর থাকে, মালামাল আমদানি রপ্তানির কারণে। বাণিজ্যের বিকাশ হয়েছে তো বটেই নদীকে কেন্দ্র করে বিকাশ লাভ করছে পর্যটনশিল্পও। এক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, টেকনাফের সেন্টমার্টিন, পটুয়াখালীর কুয়াকাটার কথা। 

এ ছাড়াও বেশকিছু নদীকেন্দ্রিক পর্যটনস্পট রয়েছে। উল্লিখিত তিনটি স্থানে প্রতি বছর দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ এবং বিদেশ থেকেও প্রচুর সংখ্যক পর্যটক এসে থাকে। বিশ্বের সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে কক্সবাজার সমুদ্রও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল (এ তালিকায় সুন্দরবনের নামও ছিল)। গৌরবের এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- জাতি হিসেবে আমাদের গৌরবগাথা। গর্ব করার মতো কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত আছে। সারা বিশ্বের মানুষ এ খবর জেনে গেছে, কক্সবাজারের নামও স্মৃতিতে স্থান করে নিয়েছে অনেকের। নদীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। সম্ভাবনা ক্ষেত্রটি ইতোমধ্যে পরিস্ফ‚টিতও হয়েছে। তবে এটা আরও অনেক বড় ও অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে বলে ধারণা করা হয়। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সুপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাওয়াই এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত।

মানুষ নদীর কাছে, সমুদ্রের কাছে আশ্রয় পায়, ভরসা পায়। সাহস ও অনুপ্রেরণার উৎসও নদী-সাগর। তাই তো মানুষ দু’দণ্ড শান্তির প্রত্যাশায় নদীপানে, সাগরাভিমুখে যাত্রা করে। শীতল জলে মন জুড়ায়। শরীর জুড়ায়। উজ্জীবিত হয়ে ওঠে জাদুকরী স্পর্শে। জীবনকে অনুভব করতে শেখে নতুনভাবে। গুণীজনরা বলেন, শিখতে চাইলে নদী-সাগরের কাছে যাও, নদী-সাগরই হচ্ছে সবচেয়ে বড় শিক্ষক।

আমাদের জাতীয় জীবনেও নদী জড়িয়ে আছে নানাভাবে, নানাদিকে। বাংলা সাহিত্যে নদী বেশ বড় একটা অংশজুড়ে আছে। সেলুলয়েডের ফিতাও বাদ থাকেনি। নদী, নদীতীরের মানুষ তথা জেলে সম্প্রদায় মূর্ত হয়ে উঠেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি, অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতায় বাক্সময় হয়ে ওঠে কপোতাক্ষ নদ, কাজী নজরুল ইসলামের কলমে ফুল হয়ে ফুটেছে কর্ণফুলী নদী, আল মাহমুদের কলমে তিতাস নদীর যে বর্ণনা, অনুভূতি তা ছুঁয়ে যায় মানুষের মন। নদী, বর্ষা এসেছে রবীন্দ্রনাথের কলমেও নানারূপে, নানা ভঙ্গিমায়। বন্যা নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি ‘সাহসী’ কবিতা আছে। কবিতাটিতে ফুঠে উঠেছে বন্যার ভিন্ন রূপ-ব্যঞ্জনা।

প্রলয়ঙ্করী, সর্বনাশা বন্যা চিত্রিত হয় এভাবে- প্রিয় ইন্দিরা, তুমি বিমানের জানালায় বসে,
গুজরাটের বন্যা দেখতে যেও না।
উঁচু থেকে তুমি দেখতে পাও মাইল মাইল শূন্যতা
প্রকৃতির নিয়ম ও নিয়মহীনতার সর্বনাশা মহিমা
নতুন জলের প্রবাহ, তেজী স্রোত যেন মেঘলা আকাশ উল্টো/ হয়ে শুয়ে আছে পৃথিবীতে/ মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো বাড়ি, কাণ্ডহীন গাছের পল্লবিত মাথা/ ইন্দিরা, তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন তোমার মুখ ফস্কে/ বেরিয়ে যেতে পারে, বাহ কী সুন্দর!
বাংলা সাহিত্য ঘাঁটলে এরকম অসংখ্য চিত্র চোখে পড়বে- যা বর্ষা-বন্যা নদীকে ভিন্নদৃষ্টিতে দেখার পথ সুগম করে দেয়। 

ঋত্বিক ঘটক তিতাস একটি নদীর নাম, গৌতম ঘোষ পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের চিত্ররূপ দিয়ে অনবদ্য শিল্প সৃষ্টির নজির স্থাপন করেছেন। তবে সিনেমায় নদীকে বিশদভাবে তুলে ধরার চেষ্টা যিনি করেছেন-চলচ্চিত্রাচার্য আলমগীর কবিরের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয়। তার পরিচালিত অনেক চলচ্চিত্র জুড়ে আছে নদী। বাংলা চলচ্চিত্রে সম্ভবত তিনিই নদীকে এনেছেন সবচেয়ে বেশি। ‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবিটি ভাবুক দর্শককে নিয়ে যায় নতুন সীমানায়। ঝড়, বন্যা, নদী, সর্বস্ব হারিয়েও টিকে থাকার প্রচণ্ড সংগ্রাম- চিত্রিত হয়েছে তার বহুদর্শী দৃষ্টিতে। তার সিনেমার মূলমন্ত্র ছিল বাংলাদেশ জানতে হলে নদীর কাছে যাও। নদীর কাছে যাওয়ার বিকল্প নেই।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ছোটকাগজ