চুয়াডাঙ্গায় ফসলের বদলে দালান: কৃষিজমি যাচ্ছে নিঃশেষের পথে

চুয়াডাঙ্গা জেলায় গত এক দশকে ফসলি জমির পরিমাণ কমেছে পাঁচ হাজার হেক্টরেরও বেশি। দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন এবং দালানকোঠা নির্মাণের ফলে এ জেলার কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। এতে একদিকে যেমন কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, অন্যদিকে হুমকির মুখে পড়েছে খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জেলায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ৯৯ হাজার ৪৮১ হেক্টর। এরপর প্রতি বছরই জমির পরিমাণ কমতে থাকে। ২০১৬-১৭ সালে তা নেমে আসে ৯৮ হাজার ৭৪০ হেক্টরে, পরের বছর কমে দাঁড়ায় ৯৮ হাজার ৪০০ হেক্টরে। ২০১৮-১৯ সালে জমি হয় ৯৮ হাজার ২৭৪ হেক্টর। এরপর ২০১৯-২০ সালে তা আরও কমে ৯৭ হাজার ৫৭৩ হেক্টর এবং ২০২০-২১ সালে দাঁড়ায় ৯৭ হাজার ৭৯ হেক্টরে।
জমি হ্রাসের এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে জমির পরিমাণ হয় ৯৬ হাজার ৩৫৩ হেক্টর, ২০২২-২৩ অর্থবছরে নেমে আসে ৯৫ হাজার ৬৩৯ হেক্টরে। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জেলায় আবাদি জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯৪ হাজার ২২০ হেক্টরে। এ হিসেবে এক দশকে চুয়াডাঙ্গা জেলায় কৃষিজমি কমেছে ৫ হাজার ২৬১ হেক্টর, যা গড়ে প্রতি বছর ০.৭২ শতাংশ হারে হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়।
চুয়াডাঙ্গা শহরের দৌলতদিয়া-আলুকদিয়া সড়কের পাশে একসময় যেসব জমিতে ধান, সবজি, তুলা ও বিভিন্ন মৌসুমি ফসল চাষ হতো, এখন সেখানে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন, দোকানপাট, কলকারখানা ও ইটভাটা। দৃশ্যপট পাল্টে গেছে পুরো এলাকার।
আলুকদিয়া গ্রামের কৃষক মজিদ মিয়া বলেন, “আগে আমাদের মাঠে শুধু ধান, পেঁয়াজ, তুলা চাষ হতো। এখন চারপাশে শুধু দোকান আর ঘরবাড়ি। জমি না থাকলে চাষ করব কোথায়?”
ঝোড়াঘাটা গ্রামের কৃষক কাশেম আলী বলেন, “দেখতে দেখতে চোখের সামনেই জমি চলে গেল। যেসব জমিতে ধান-মাসকলাই হতো, এখন সেখানে দালান।”
হুচুকপাড়া গ্রামের মুজিবুল হক বলেন, “ভালাইপুর মোড়ে যেখানে ধানক্ষেত ছিল, সেখানে এখন কংক্রিটের ভবন। আমাদের উর্বর জমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।”
কৃষকদের অভিযোগ, জমির দাম ও রেজিস্ট্রেশন খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় কৃষিজমি হাতবদল হচ্ছে সহজেই। এই সুযোগে অনেকেই কৃষিজমি কিনে সেখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করছেন। আলুকদিয়ার কৃষক শাহাবুল ইসলাম বলেন, “জমির রেজিস্ট্রেশন সহজ হওয়ায় যে কেউ কৃষিজমি কিনে ফ্যাক্টরি করছে। উৎপাদন তো কমবেই। এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।”
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, “আবাদি জমি কমে গেলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আমরা লক্ষ্য করছি, জেলার বিভিন্ন জায়গায় ফসলি জমিতে শিল্প-স্থাপনা গড়ে উঠছে। তবে আমরা কৃষকদের সচেতন করছি এবং জমি রক্ষায় পরামর্শ দিচ্ছি।”
তিনি আরও জানান, জমির ঘাটতি পুষিয়ে নিতে একই জমিতে বছরে তিন থেকে চারবার ফসল উৎপাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করেও উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে।
স্থানীয় কৃষকদের দাবি, কৃষিজমি রক্ষা করতে হলে অনিয়ন্ত্রিত জমি বিক্রি বন্ধ করতে হবে এবং কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। না হলে অদূর ভবিষ্যতে চুয়াডাঙ্গা জেলায় ফসল নয়, থাকবে শুধু দালান আর কারখানা।
Comments