টায়ার পোড়ানোর কারখানার কালো ধোঁয়া ও তীব্র দুর্গন্ধে গোটা এলাকার বাতাস হয়ে ওঠে ভারী ও বিষাক্ত। আমাদের কতটা শারীরিক কষ্ট হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এই ফার্নেস অয়েল তৈরির কারখানার মাধ্যমে বায়ুদূষণের ফলে ধীরে ধীরে আমরা অসুস্থ জাতিতে পরিণত হচ্ছি। এই দূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে আমাদের এলাকার শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠরা। ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে আমাদের সাভারের ভাকুর্তা এলাকা। কিন্তু বায়ুদূষণ কমানোর জন্য সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেই প্রশাসনের। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
শুক্রবার (৭ নভেম্বর) সাভারে বায়ুদূষণ কমাতে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ভাঙাব্রিজ এলাকায় আয়োজিত মানববন্ধনে বক্তারা এসব কথা বলেন। মানববন্ধনের আয়োজন করেন সামাজিক সংগঠন ‘তারুণ্যের জাগরণ’। এ সময় ভাকুর্তা ইউনিয়নের বাসিন্দারাও অংশ নেন এই কর্মসূচিতে।
মানববন্ধনের বক্তব্যে তারুণ্যের জাগরণ সংগঠনের সদস্য আবু নাঈম বলেন, সাভারের ভাকুর্তায় অবস্থিত ফার্নেস অয়েল কারখানা থেকে বিষাক্ত ধোঁয়া বের হয়, তা থেকে আমাদের এলাকার বয়োবৃদ্ধ ও শিশুরা বায়ুদূষণে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত।
বায়ুদূষণের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে বেড়ে উঠবে—এমন আশঙ্কা করে তিনি বলেন, “ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। তাঁদের শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হিসেবে বেড়ে উঠতে দিতে পারি না।”
তিনি আরও বলেন, সাভার একদিকে যেমন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত, অন্যদিকে বায়ুদূষণের পরিমাণও দিন দিন বেড়ে চলেছে। এর কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি, পরিবেশ অবক্ষয় ও নানাবিধ সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে এসব অবৈধভাবে গড়ে ওঠা টায়ার কারখানা বন্ধ করতে হবে।
সামাজিক সংগঠন তারুণ্যের জাগরণের আরেক সদস্য মো. এমদাদুল হক বলেন, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০২২-এর বিধি ৫-এর ক্ষমতাবলে সমগ্র সাভার উপজেলাকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করা হয়েছে।
বিধি ৫ অনুযায়ী, সাভার এলাকার বায়ুমান নির্দিষ্ট মানমাত্রা অতিক্রম করে মারাত্মক দূষিত এলাকায় পরিণত হয়েছে। সেজন্য এলাকাটিকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করা হয়েছে। ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণার পরও বন্ধ হয়নি দূষণকারী ফার্নেস কারখানা এটা আমাদের জন্য হতাশাজনক।
তিনি আরও বলেন, জারি হওয়া পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল, পরিবেশ অধিদপ্তরের সার্বক্ষণিক বায়ুমান পরিবীক্ষণ কেন্দ্রগুলোর তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সাভারের বায়ুর বার্ষিক মানমাত্রা জাতীয় নির্ধারিত মানমাত্রার প্রায় তিন গুণ অতিক্রম করেছে। জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যের ওপর এই মাত্রাতিরিক্ত দূষিত বায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনায় ঢাকা জেলার সাভার উপজেলা মারাত্মক বায়ুদূষণযুক্ত এলাকায় পরিণত হয়েছে। তবে এই বায়ুদূষণ রোধে কোনো প্রকার কার্যকর পদক্ষেপ এখনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ দেখাতে পারেনি।
এমদাদুল হক আরও বলেন, আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে এই সকল অবৈধ টায়ার পুড়িয়ে তেল তৈরির কারখানা বন্ধ করে নিজেদের রক্ষা করতে চাই। দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব অবৈধ কারখানা বন্ধ না হলে আমরা কঠোর থেকে কঠোর কর্মসূচি পালন করতে বাধ্য হবো।
তারুণ্যের জাগরণ পরিচালনা কমিটির সদস্য মেহেদী হাসান দিদার বলেন, সারারাত চলতে থাকা টায়ার পোড়ানোর কারখানার কালো ধোঁয়া ও তীব্র দুর্গন্ধে গোটা এলাকার বাতাস হয়ে ওঠে ভারী ও বিষাক্ত। আমাদের কতটা শারীরিক কষ্ট হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
দিদার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সাভারের পরিবেশদূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আমাদের এই এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। সারা দেশে প্রবহমান তীব্র দাবদাহের পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি বায়ুদূষণও দায়ী। তিনি বলেন, তাপমাত্রার বৃদ্ধি কমাতে বায়ুদূষণ কমানো জরুরি। আমাদের ভাকুর্তায় টায়ার পুড়িয়ে যে বায়ুদূষণ হচ্ছে, সেটা বন্ধ হওয়া জরুরি। এই সাভারে বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। বরং প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। অতি দ্রুত বায়ুদূষণ কমাতে পদক্ষেপ না নিলে জনজীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। তিনি বায়ুদূষণ ও তাপমাত্রা কমানোর জন্য বনায়ন ও জলাভূমি সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
আবুল ফাতেহ নামে অন্য এক সংগঠক বলেন, সাভারের ভাকুর্তায় বিভিন্ন কৃষিজমিতে গড়ে উঠেছে একাধিক অবৈধ ফার্নেস অয়েল তৈরির কারখানা। যেখানে জ্বালানি তেল উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে বাইসাইকেল, রিকশা ও গাড়ির পুরোনো টায়ার গলিয়ে তেল উৎপাদন করা হচ্ছে।কৃষিজমিতে গড়ে তোলা এসব কারখানার ঘনকালো ধোঁয়া আর উৎকট গন্ধে বিপন্ন হচ্ছে ভাকুর্তার পরিবেশ, সেই সাথে আমাদের জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়ছে । বায়ুদূষণের সঙ্গে ক্ষতি করছে মানুষজন, পশুপাখি ও বিভিন্ন উঠতি ফসলের। বছরের পর বছর ধরে এই অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে আসছি আমরা।
তিনি বলেন, আমরা যতটুকু জানি পরিবেশ অধিদপ্তর বা কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই টায়ার জ্বালিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ফার্নেস ওয়েল তৈরি করে আসছে এই কারখানা গুলো। ভাকুর্তা এলাকায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হলেও প্রশাসন স্থায়ী ভাবে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
আবুল ফাতেহ আরও বলেন, প্রতিবছর প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ভেঙে ফেলা হলেও বাস্তবে তার সুফল আমরা পাইনি। রাতারাতি পুনরায় কারখানাগুলো চালু করে দেওয়া হয়। আমরা চাই দ্রুত সময় এর থেকে রক্ষা পেতে কার্যকরী পদক্ষেপ।
মানববন্ধনে এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির সদস্য মজিবর রহমান, মোরসালিন, আল আমিনসহ স্থানীয়রা।




Comments