Image description

১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর ছিল মুক্তিযুদ্ধের এক টার্নিং পয়েন্ট। এদিন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ শহর মুক্ত হওয়ার ফলে বিজয় আরও কাছে আসে, এবং পাকবাহিনী চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়তে থাকে। মাত্র এক সপ্তাহ পরই, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। 

মূল ঘটনাগুলো নিচে তুলে ধরা হলো; 
১. ময়মনসিংহের মুক্তি:
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে বড় আকারের আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনী তীব্র প্রতিরোধের পর পিছু হটতে বাধ্য হয়। দুপুরের মধ্যে ময়মনসিংহ সম্পূর্ণ মুক্ত ঘোষণা করা হয়।

২. যশোর ক্যান্টনমেন্ট পরিত্যাগ:
৭ ডিসেম্বর রাতে যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর ৮ ডিসেম্বর ভোরে পাকিস্তান সেনারা ক্যান্টনমেন্ট পরিত্যাগ করে পালিয়ে যায়। এদিন যশোর শহর নিয়ন্ত্রণে নেয় ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা। 
যশোর ছিল পাকিস্তান বাহিনীর অন্যতম প্রধান ঘাঁটি—এটির পতন পাকিস্তানের সামরিক অবস্থানকে বড়ভাবে দুর্বল করে। 

৩. চট্টগ্রামে তীব্র লড়াই:
চট্টগ্রাম বন্দর ও শহরের আশপাশে ৮ ডিসেম্বর সারাদিন তীব্র যুদ্ধ চলে। বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার জন্য আক্রমণ বাড়ানো হয়।পাকবাহিনী ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে থাকে।

৪. ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তি:
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর মুক্ত হয়। আশেপাশের এলাকা থেকেও পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে।

৫. সারা দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়া:
যশোর, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া—এ তিনটি কৌশলগত অবস্থান হারানো ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য বড় ধাক্কা। ঢাকায় অবস্থানরত হাইকমান্ডও পতনের আভাস পেতে শুরু করে। 

৬. পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে ভারতীয় সেনা প্রধানের আত্মসমর্পণের নির্দেশ: 
৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এইচ এফ জে মানেকশ। আকাশবাণী রেডিও থেকে উর্দু, হিন্দি ও পশতু ভাষায় এটি প্রচারিত হয়।

তিনি তার বক্তব্যে বলেন, 'সময় দ্রুত এগিয়ে চলছে। পাকিস্তানি সেনাদের উচিত ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করা। বর্তমানে পাকিস্তানি সেনারা বরিশাল  ও নানা বন্দর থেকে নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরে এসে সমবেত হচ্ছে। কিন্তু এখানেও তোমরা আশ্রয় নিতে পারবে না। শিগগির এখান থেকেও উচ্ছেদ হবে। ইতোমধ্যে তোমাদের বিমানবাহিনী অকেজো, তাদের থেকে তোমাদের সাহায্য পাওয়ার কোনো উপায় নেই। বহিঃবিশ্বের কোনো দেশ থেকেও তোমরা সাহায্য পাবে না। আমরা তোমাদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেছি। সমুদ্রপথেও কেউ তোমাদের কাছে রসদ সাহায্য পাঠাতে পারবে না। তোমাদের হাতে এখন প্রাণ বাঁচানো একটিই সুযোগ। সেটি হলো আত্মসমর্পণ। আর যদি আত্মসমর্পণ না করো, তবে তোমাদের ভাগ্যে রয়েছে নিশ্চিত মৃত্যু। যদি তোমরা আত্মসমর্পণ করো, তবে জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী তোমাদের প্রতি মানবিক আচরণ করা হবে।'  

৭. প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এর বক্তব্য:
৮ ডিসেম্বর মুজিবনগর থেকে দেওয়া দেওয়া এক বেতার ভাষণে জাতির উদ্দেশে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। পাকিস্তানি হানাদাররা এখন প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের পরাজয় এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।'

তাজউদ্দীন আহমদ আরও বলেন, 'আজ আমাদের সবাইকে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে শত্রুর ওপর শেষ আঘাত হানতে হবে এবং বাংলাদেশের মাটিতে তাদের কবর রচনা করতে হবে। দেশ যখন আমাদের আহ্বান জানাচ্ছে, তখন সে আহ্বানে যেন আমরা সাড়া দিতে পারি। আগামীকাল যেন কখনো আমাদের অপবাদ দিতে না পারে যে, আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করিনি।'

একইসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেওয়ার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। 

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'এই উপমহাদেশে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রস্তাব তুলেছে, তাতে বোঝাই গেছে সংঘর্ষের মূলে সে পৌঁছায়নি। এর মূল কারণ বিষয়ে আমেরিকা চোখ বন্ধ করে আছে। এটা তার মানসিক বিকৃতির পরিচায়ক। চীন পাকিস্তানকে সবসময় বাংলাদেশে গণহত্যা চালাতে উসকানি দিয়েছে।'   

৮. পাকিস্তানের নাগরিকদের যুদ্ধ তহবিল খোলার আহ্বান ইয়াহিয়া খানের:

এদিকে ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানের নাগরিকদের যুদ্ধ তহবিল খোলার আহ্বান জানান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।

এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, 'জনগণকে অর্থের অপচয় বন্ধ ও উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দেশের এই সর্বাত্মক যুদ্ধের সময় সবাইকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। যে নাগরিকদের মাসিক আয় ২ হাজার টাকার বেশি, তাদের শতকরা ১০ টাকা এবং যাদের আয় তার থেকে কম, তাদেরকে শতকরা ৫ টাকা হারে প্রতিরক্ষা তহবিলে দিতে হবে।'