বর্তমান সমাজে চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম—সবখানেই পরনিন্দা বা গিবতের ছড়াছড়ি। আমরা অবলীলায় অন্যের দোষত্রুটি নিয়ে আলোচনা করি, যা আমাদের আমলনামাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ইসলামে যে কয়টি কাজকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং যার শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ, তার মধ্যে অন্যতম হলো গিবত বা পরনিন্দা। এটি এমন এক পাপ, যা মানুষের নেক আমলকে আগুনের মতো পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।
গিবত বা পরনিন্দার সংজ্ঞায় রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমরা কি জানো গিবত কাকে বলে?’ সাহাবিগণ বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন।’ তিনি বললেন, ‘তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে।’ সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি যা বলছি তা যদি ওই ব্যক্তির মধ্যে থাকে?’ রাসূল (সা.) বললেন, ‘তুমি যা বলছো তা যদি তার মধ্যে থাকে তবেই তো তুমি তার গিবত করলে। আর যদি তা তার মধ্যে না থাকে, তবে তুমি তাকে অপবাদ (বুহতান) দিলে।’ (সহিহ মুসলিম: ২৫৮৯)
পবিত্র কুরআনে গিবতের ভয়াবহতা
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে গিবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। এর চেয়ে ঘৃণ্য কাজ আর হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“তোমাদের কেউ যেন কারো গিবত না করে। তোমাদের কেউ কি চায় যে, সে তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করবে? তোমরা তো এটাকে ঘৃণাই করে থাকো। আর আল্লাহকে ভয় করো।”
(সূরা হুজুরাত, আয়াত: ১২)
এছাড়াও সূরা হুমাজাহ-তে আল্লাহ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন:
“দুর্ভোগ প্রত্যেক সেই ব্যক্তির জন্য, যে (সামনাসামনি) মানুষের ধিক্কার দেয় এবং (অসাক্ষাতে) গিবত করে।”
(সূরা হুমাজাহ, আয়াত: ১)
গিবতকারীর শাস্তি: হাদিসের আলোকে
গিবত বা পরনিন্দার শাস্তি ইহকাল ও পরকাল—উভয় জগতেই অত্যন্ত ভয়াবহ। হাদিস শরীফে এর শাস্তির লোমহর্ষক বর্ণনা এসেছে।
তামার নখ দিয়ে নিজেকে আঁচড়ানো
মেরাজের রাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এমন এক সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যাদের শাস্তি দেখে তিনি শিউরে ওঠেন। তিনি বলেন:
“আমি যখন মেরাজে গেলাম, তখন এমন কিছু লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখগুলো ছিল তামার তৈরি। তারা নিজেদের নখ দিয়ে অনবরত নিজেদের মুখমণ্ডল ও বুকের গোশত খামচে ছিঁড়ছিল। আমি জিবরাঈল (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা দুনিয়াতে মানুষের গোশত খেত (গিবত করত) এবং তাদের মানসম্মান নষ্ট করত।”
(সুনানে আবু দাউদ: ৪৮৭৮)
কবরের শাস্তি
একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) দুটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ‘এই দুই কবরবাসীর শাস্তি হচ্ছে। তবে তাদের বড় কোনো অপরাধের জন্য শাস্তি হচ্ছে না (যা থেকে বেঁচে থাকা কঠিন ছিল)। তাদের একজন প্রস্রাবের ছিটা থেকে বেঁচে থাকত না এবং অন্যজন চোগলখুরি বা গিবত করে বেড়াত।’ (সহিহ বুখারি)
ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“গিবত বা পরনিন্দা ব্যভিচারের (জিনা) চেয়েও মারাত্মক।” সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটা কীভাবে সম্ভব? তিনি বললেন, “ব্যভিচার করার পর মানুষ তওবা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু গিবতকারীকে আল্লাহ ততক্ষণ ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ না যার গিবত করা হয়েছে, সে তাকে ক্ষমা করে।”
(মিশকাতুল মাসাবিহ)
কিয়ামতের দিন নিস্ব বা দেউলিয়া হওয়া
গিবতকারীর নেক আমল কিয়ামতের দিন যার গিবত করা হয়েছে তাকে দিয়ে দেওয়া হবে। রাসূল (সা.) সাহাবিদের ‘মুফলিস’ বা নিস্ব ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা বললেন, যার টাকা-পয়সা নেই। তখন রাসূল (সা.) বললেন:
“আমার উম্মতের মধ্যে প্রকৃত নিস্ব সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন নামাজ, রোজা ও যাকাত নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু সে দুনিয়াতে কাউকে গালি দিয়েছে, কারো নামে অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ ভক্ষণ করেছে বা কাউকে হত্যা করেছে। ফলে তার নেক আমলগুলো পাওনাদারদের (যাদের ক্ষতি করেছে) দিয়ে দেওয়া হবে। যদি নেক আমল শেষ হয়ে যায়, তবে পাওনাদারদের গুনাহ তার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।”
(সহিহ মুসলিম)
গিবত থেকে বাঁচার উপায় ও প্রতিকার
এই ভয়াবহ পাপ থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সচেতন হতে হবে:
জিহ্বাকে সংযত রাখা: অপ্রয়োজনীয় কথা বলা থেকে বিরত থাকা।
অন্যের দোষ না খোঁজা: নিজের দোষের দিকে নজর দেওয়া। যে নিজের দোষ দেখে, সে অন্যের দোষ চর্চার সময় পায় না।
মজলিস ত্যাগ করা: কোথাও গিবত শুরু হলে তা থামানোর চেষ্টা করা অথবা সেই স্থান ত্যাগ করা।
গিবত হয়ে গেলে করণীয় (কাফফারা)
যদি ভুলবশত কারো গিবত করে ফেলা হয়, তবে এর কাফফারা হলো:
-
প্রথমত, আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে তওবা করা।
-
দ্বিতীয়ত, যার গিবত করা হয়েছে, সুযোগ পেলে তার কাছে ক্ষমা চাওয়া।
-
যদি ক্ষমা চাওয়া সম্ভব না হয় (যেমন—লজ্জা বা সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে), তবে ওই ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কাছে বেশি বেশি মাগফিরাত কামনা করা এবং তার গুণগান করা।
গিবত বা পরনিন্দা একটি ‘হাক্কুল ইবাদ’ বা বান্দার হকের সাথে সম্পৃক্ত অপরাধ। আল্লাহ তাঁর নিজের হক মাফ করতে পারেন, কিন্তু বান্দার হক মাফ করবেন না। তাই আসুন, আমরা আমাদের জিহ্বাকে হেফাজত করি, অন্যের সম্মান রক্ষা করি এবং আখেরাতের ভয়াবহ শাস্তি থেকে নিজেদের রক্ষা করি।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে গিবত ও পরনিন্দা নামক এই মহাব্যাধি থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
Comments