ধর্ষণ বর্তমান সময়ের এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এটি কেবল একটি নারীর সম্ভ্রমহানি নয়, বরং মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ। ইসলাম মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। যে ব্যক্তি অন্যের সম্ভ্রম হরণ করে, ইসলামি শরিয়তে তার কোনো ছাড় নেই। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে ধর্ষণকে ‘মুহারাবা’ বা ‘ফাসাদ ফিস জমিন’ (পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি) হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে, যার শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ।
ধর্ষণ ও ব্যভিচারের পার্থক্য
ইসলামে পারস্পরিক সম্মতিতে অবৈধ সম্পর্ককে ‘জিনা’ (ব্যভিচার) বলা হয়। আর জোরপূর্বক বা ভীতি প্রদর্শন করে যে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করা হয়, তাকে ‘জিনা বিল জাবর’ বা ধর্ষণ বলা হয়।
-
ভুক্তভোগীর নির্দোষিতা: ধর্ষণের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী নারী বা পুরুষ সম্পূর্ণ নির্দোষ। ইসলামি শরিয়ত মতে, জোরপূর্বক গুনাহে লিপ্ত করানো হলে ভুক্তভোগীর কোনো পাপ হয় না এবং তার ওপর কোনো শাস্তিও প্রয়োগ হয় না। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“আমার উম্মতের ভুলত্রুটি, বিস্মৃতি এবং যা তারা বাধ্য হয়ে করে, তা ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে।”
(ইবনে মাজাহ: ২০৪৫)
ইসলামে ধর্ষকের শাস্তি
ইসলামি আইনজ্ঞদের (ফুকাহা) মতে, অপরাধের ধরন ও তীব্রতা অনুযায়ী ধর্ষকের শাস্তি মূলত দুইভাবে হতে পারে:
হদ্দ বা নির্ধারিত শাস্তি (ব্যভিচারের শাস্তি)
যদি ধর্ষণের অপরাধটি সাধারণ জিনার মানদণ্ডে বিচার করা হয়, তবে অপরাধীর বৈবাহিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে শাস্তি নির্ধারিত হয়:
-
বিবাহিত অপরাধী: যদি ধর্ষক বিবাহিত হয়, তবে তার শাস্তি হলো ‘রজম’ বা পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড। জনসমক্ষে মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে পাথর মারা হবে।
-
অবিবাহিত অপরাধী: যদি ধর্ষক অবিবাহিত হয়, তবে তাকে ১০০ বেত্রাঘাত করা হবে এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর বা কারাদণ্ড দেওয়া হবে।
মুহারাবা বা হিরাবাহ (সন্ত্রাস ও বিপর্যয় সৃষ্টির শাস্তি)
অধিকাংশ ইসলামি স্কলার ও ফকিহদের মতে, ধর্ষণ কেবল যৌন অপরাধ নয়, বরং এটি এক ধরনের সন্ত্রাস ও বলপ্রয়োগ। যদি ধর্ষণের সাথে অস্ত্র প্রদর্শন, অপহরণ বা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়, তবে এটি ‘হিরাবাহ’ (ডাকাতি বা সন্ত্রাস) এর অন্তর্ভুক্ত হবে। সূরা মায়েদাতে আল্লাহ তায়ালা ‘হিরাবাহ’-এর শাস্তি ঘোষণা করেছেন:
“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং জমিনে ফাসাদ বা বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি হলো—তাদের হত্যা করা হবে, অথবা শূলে চড়ানো হবে, অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে, অথবা তাদের দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে।”
(সূরা মায়েদা, আয়াত: ৩৩)
মালিকি মাজহাব ও আধুনিক অনেক ফকিহদের মতে, ধর্ষক যেহেতু জোরপূর্বক সম্ভ্রম লুট করে সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তাই তাকে এই আয়াতের অধীনে মৃত্যুদণ্ড বা শূলে চড়ানো যেতে পারে। এখানে অপরাধী বিবাহিত না অবিবাহিত—তা দেখার বিষয় নয়, অপরাধের নৃশংসতাই মূখ্য।
তা’জির বা রাষ্ট্রপতির বিবেচনা
যদি সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ‘হদ্দ’ বা নির্দিষ্ট শাস্তি কার্যকর করা না যায়, তবুও বিচারক অপরাধের পারিপার্শ্বিক প্রমাণ (যেমন—DNA টেস্ট, সিসিটিভি ফুটেজ, মেডিকেল রিপোর্ট) ও অপরাধের ভয়াবহতা বিবেচনা করে ‘তা’জির’ হিসেবে ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারেন। ইসলামি রাষ্ট্রপ্রধান বা বিচারক জনস্বার্থে যে কোনো কঠোর শাস্তি আরোপ করতে পারেন।
ভুক্তভোগীর আর্থিক ক্ষতিপূরণ
ইসলাম কেবল শাস্তি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরং ভুক্তভোগীর সম্মানের মূল্যও নির্ধারণ করেছে। ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ (রহ.)-এর মতে, ধর্ষককে শাস্তির পাশাপাশি ভুক্তভোগী নারীকে ‘মোহরে মিসাল’ (তার সমমানের নারীদের যে মোহরানা ধরা হয়) বা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এটি নারীর সম্ভ্রমের বিনিময় নয়, বরং তার ওপর যে জুলুম করা হয়েছে, তার প্রায়শ্চিত্ত ও মানসিক সান্ত্বনা।
প্রমাণ ও বিচার প্রক্রিয়া
অনেকে মনে করেন ইসলামে ধর্ষণের প্রমাণের জন্য ৪ জন সাক্ষী লাগে, যা ভুল ধারণা। ৪ জন সাক্ষী মূলত ‘সম্মতিপূর্ণ ব্যভিচার’-এর ক্ষেত্রে প্রয়োজন। ধর্ষণের ক্ষেত্রে এটি ‘জোরজবরদস্তি’ বা ফৌজদারি অপরাধ। এখানে মেডিকেল রিপোর্ট, পারিপার্শ্বিক আলামত এবং ভুক্তভোগীর আর্তনাদ—সবই প্রমাণ হিসেবে গণ্য হতে পারে। হযরত ওমর (রা.) এবং আলী (রা.)-এর শাসনামলে পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে ধর্ষণের বিচার করার নজির রয়েছে।
উপসংহার
ইসলামে ধর্ষণের শাস্তি লোক দেখানো কোনো বিষয় নয়, বরং এটি অপরাধের মূল উৎপাটন করার জন্য। জনসমক্ষে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড বা শূলে চড়ানোর মতো কঠোর শাস্তি কার্যকর হলে সমাজে অন্য কেউ এমন জঘন্য কাজ করার সাহস পাবে না।
সুতরাং, সমাজ থেকে ধর্ষণ নির্মূল করতে হলে কেবল আইন প্রণয়ন করলেই হবে না, বরং ইসলামি অনুশাসন মেনে চলা, পর্দা প্রথা ও শালীনতা বজায় রাখা এবং অপরাধীর দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
Comments